জন্মশতবর্ষে শ্রদ্ধাঞ্জলি : ঋত্বিককুমার ঘটক

আগামীকাল ৪ নভেম্বর। বিশ্বচলচ্চিত্রের উজ্জ্বলতম একটি দিন। মহান চলচ্চিত্রকার ঋত্বিককুমার ঘটকের জন্মশতবর্ষের দিন। ১৯২৫ সালের এই দিনে ঋত্বিক ও তাঁর সাত মিনিটের ছোট যমজবোন প্রতীকি ঢাকার লক্ষ্মী বাজারের ঝুলনবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁদের পিতা সুরেশচন্দ্র ঘটক সেসময় ঢাকার জেলা প্রশাসক ছিলেন। তাঁদের আদি নিবাস পাবনা জেলার ভারেঙ্গা গ্রামে। গ্রামটি পরে পদ্মায় বিলীন হয়ে যায়। তেমনই লক্ষ্মী বাজারের ঝুলনবাড়িরও অস্তিত্ব আজ আর নেই। ১৯৪৭–এর দেশ ভাগের কয়েকবছর আগে ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট সুরেশচন্দ্র ঘটক চাকুরি থেকে অবসর গ্রহণের পর রাজশাহী শহরের মিয়াপাড়ায় স্থায়ী নিবাস নির্মাণ করে মাত্র দুয়েক বছর বসবাস করে দেশ ছাড়তে বাধ্য হন। ২০২৪ সালের শেষের দিকে বাড়িটি ভেঙে ফেলে জবর দখলকারীরা। পূর্ববঙ্গে বারবার বাড়ি হারানোর বেদনা ঋত্বিককে আমৃত্যু পীড়িত করেছে। বাড়ি আর দেশ হারানোর মর্মবেদনা তাঁর প্রতিটি চলচ্চিত্রে ধ্বনিত হয়েছে। সারাটি জীবন তিনি নতুন বাড়ির সন্ধান করে গেছেন। পাননি। বাড়ি হারানোর যন্ত্রণা নানান অনুষঙ্গে তিনি চিত্রায়িত করেছেন ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’ চলচ্চিত্রে।

ঋত্বিক অনেক অবহেলা, অপমান, বঞ্চনার শিকার হয়ে দুরারোগ্য লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত হয়ে মাত্র ৫১ বছর বয়সে প্রয়াত হন কলকাতার পিজি হাসপাতালে ১৯৭৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি। অতিরিক্ত মদ্যপান তাঁর এই দুরারোগ্যের কারণ । ১৯৬২ সালে সুবর্ণরেখা ছবিটি নির্মাণের পর যখন মুক্তি দিতে পারছিলেন না, আপোষহীনতার কারণে এর আগে ও পরে চারটি কাহিনীচিত্র; বেদেনী, কত অজানারে, বগলার বঙ্গদর্শন, রঙের গোলাম এবং চারটি প্রামাণ্যচিত্র; সিভিল ডিফেন্স, কমিউনাল হারমোনি, ইন্দিরা গান্ধী ও রামকিঙ্কর শেষ করতে পারছিলেন না, কমিউনিস্ট পার্টিতে সক্রিয় থেকেও সহকর্মীদের কাছে পদে পদে লাঞ্ছিত হচ্ছিলেন, নিগৃহীত হচ্ছিলেন নিজের পরিবারেও, নির্মিত ছবিগুলি সাবটাইটেলের অভাবে বিদেশি চলচ্চিত্র উৎসবে পাঠাতে পারছিলেন না, তখন ক্রমশ চরম হতাশাগ্রস্থ হয়ে পড়েন এবং আসক্ত হয়ে পড়েন সীমাহীন মদ্যপানে। অথচ এর আগ পর্যন্ত তিনি মদ্যপানকে চরম ঘৃণা করতেন। এর বিরুদ্ধে তিনি নানাভাবে সোচ্চার থাকতেন। সিনে টেকনিশিয়ানরা যখন বিভিন্ন মাদকে আসক্ত হয়ে পরিবার বিচ্ছিন্ন জীবনযাপন করতেন, ঋত্বিক তাদের সে জীবন থেকে ফিরিয়ে এনে টেকনিশিয়ান স্টুডিওতে শ্রমিক ইউনিয়ন গড়ে তোলেন এবং তাদের ন্যায্য পাওনা আদায়ে অগ্রণী নেতৃত্বে নিজেকে নিয়োজিত করেন। এর ফলে তিনি প্রশাসনের বিরাগভাজন হয়ে পড়েন যা তাঁর নিজের ক্যারিয়ারে বিরূপ প্রভাব তৈরি করে।

ঋত্বিকের শিল্পী জীবনের সূচনা নাটক ও সাহিত্যে। রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন তরুণ বয়স থেকে। কিন্তুু বেশি সংখ্যক মানুষের কাছে নিজের চিন্তা চেতনা ও সৃষ্টিশীলতাকে পৌঁছে দেবার প্রত্যাশায় তিনি চলচ্চিত্র মাধ্যমে সম্পৃক্ত হন। আটটি সমাপ্ত কাহিনীচিত্র; নাগরিক, অযান্ত্রিক, বাড়ি থেকে পালিয়ে, মেঘে ঢাকা তারা, কোমল গান্ধার, সুবর্ণরেখা, তিতাস একটি নদীর নাম ও যুক্তি তক্কো আর গপ্পো এবং ১২ টি স্বল্পদৈর্ঘ্যও প্রামাণ্যচিত্রের মাধ্যমে সে কাজটি করে যেতে ৫১ বছরের স্বল্পায়ন জীবদ্দশায় চেষ্টা করে গেছেন। প্রতিটি ছবিই আজ প্রাসঙ্গিকতা এবং উল্লেখযোগ্যতার কারণে নতুন নতুন ব্যাখ্যা আর অনুধাবনের মধ্য দিয়ে ক্রমশ আবিষ্কৃত হয়ে চলেছে। পাশ্চাত্যের বিভিন্ন দেশে ডিজিটালাইজেশনের মাধ্যমে ঋত্বিকের সবগুলি ছবির উন্নত প্রিন্ট তৈরি করে দর্শকদের কাছে পৌঁছে দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। এ কাজটিতে নেতৃত্ব দিচ্ছেন বিশ্বখ্যাত মার্কিন চলচ্চিত্রকার মার্টিন স্করমেসে ও ব্রিটিশ ফিল্ম ইনস্টিউিট।

পুরাণে উল্লেখিত আছে, সমুদ্র মন্থনের সময় বিশ্ব ব্রহ্মান্ডের সমস্ত গরলকে নিজ কন্ঠে ধারণ করে শিব হয়েছিলেন নীলকন্ঠ। ঋত্বিকও আমাদের সমাজের নানাবিধ গরলকে ধারণ করতে চেয়েছিলেন নিজের সৃষ্টিতে, সাহিত্যে, চলচ্চিত্রে, নাটকে এবং নিজের জীবনে। শেষ চলচ্চিত্র ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’ যেটি তাঁর আত্মজৈবনিক চলচ্চিত্র–সেই ছবির মূল চরিত্রের নাম নীলকন্ঠ বাগচী। এই চরিত্রে অসাধারণ অভিনয় করেছিলেন ঋত্বিক স্বয়ং। বাগচী ছিল ঘটক পরিবারের আদি পদবী। তাঁরা ছিলেন কাশ্মীরের কাণ্যকুঞ্জের আদি অধিবাসী।

ঋত্বিক চলচ্চিত্রের শিক্ষকতায়ও নিয়োজিত ছিলেন। প্রথমে ভিজিটিং প্রফেসর ও পরে ভাইস প্রিন্সিপাল হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন ১৯৬৫ থেকে ১৯৬৮ পর্যন্ত পুনের ফিল্ড এন্ড টিভি ইনস্টিটিউটে। এ সময় ছাত্রদের নিয়ে স্বল্পদৈর্ঘ্যের কয়েকটি কাহিনীচিত্র নির্মাণ করেন। তাঁর ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য: কুমার সাহানী, মনি কাউল, আসরানি, বিধু বিনোদন চোপড়া, আদুর গোপালকৃষ্ণ। ১৯৬৯ সালে তাঁকে পদ্মশ্রী উপাধি প্রদান করে তা আবার কেড়ে নেয়ার প্রস্তাব হয়। উপাধি প্রত্যাখ্যান করেন ঋত্বিক। ধীরে ধীরে বিষাদগ্রস্থ হয়ে পড়লে ১৯৬৯ সালে তাঁকে মানসিক রোগের হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানেও তিনি রোগী, নার্স ও চিকিৎসকদের নিয়ে নাটক মঞ্চস্থ করতে উদ্যোগী হন। সুস্থতার পর ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সাহায্যার্থে নানা কর্মকান্ডে জড়িত হয়ে পড়েন। ১৯৭২ সালে রাষ্ট্রীয় অতিথি হয়ে একুশে ফেব্রুয়ারির অনুষ্ঠানে স্বাধীন বাংলাদেশে আসেন। সে বছরই ঢাকায় শুরু করেন ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ ছবির কাজ হাবিবুর রহমান খানের প্রযোজনায়।

এ ছবির শিল্পী কলাকুশলীদের সকলেই ছিলেন বাংলাদেশের। ছবিটি মুক্তি পায় ১৯৭৩ সালে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও নারায়নগঞ্জে মুক্তি পায়। কলকাতায় মুক্তি পায় তাঁর মৃত্যুর ১৫ বছর পর ১৯৯১ সালে। শেষ ছবি যুক্তি তক্কো আর গপ্পোতে তিনি অকপটে এবং সততা ও সাহসের সঙ্গে নিজের জীবন, দর্শন ও আদর্শকে চিত্রায়িত করে গেছেন, যা বিশ্বচলচ্চিত্রের ইতিহাসে দ্বিতীয়রহিত দৃষ্টান্ত। এছবির কাহিনীর জন্যে তিনি জীবনের একমাত্র রাষ্ট্রীয় পুরস্কার পেলেও ছবিটি যথেষ্ট বিতর্কের সৃষ্টি করে। মৃত্যুকালেও শান্তি পাননি ঋত্বিক। স্ত্রীকে লেখা চিঠির শেষে লিখেন, ‘ইতি–দগ্ধভাল ঋত্বিক’ অর্থাৎ পোড়া কপাল। ‘দগ্ধভালই’ ছিল তাঁর ললাট লিখন। তবে যা কিছু সৃষ্টিকর্ম রেখে গেছেন বহুপ্রজ এই মহাশিল্পী ; যিনি ছিলেন একাধারে কবি, প্রাবন্ধিক, কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, নাট্যনির্দেশক, অভিনেতা, সংগঠক, রাজনীতিক শিক্ষক, সংগীতকার এবং চলচ্চিত্রকার, তাঁর রেখে যাওয়া সেসব কাজের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতি বছরের পর বছর ধরে তাকে নিত্যনতুন আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে নিজেদের ঋদ্ধ করে রাখতে সমর্থ হবে।

ঋত্বিকের যমজভগ্নী প্রতীতিও ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ জীবন কাটিয়ে গেছেন। বৈবাহিক সূত্রে তিনি জীবনের প্রায় পুরো সময় কাটিয়ে গেছেন পূর্ব পাকিস্তান ও বাংলাদেশে অর্থাৎ পূর্ববঙ্গে। তাঁর স্বামী সঞ্জীব দত্ত, যিনি শহিদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের পুত্র, তিনি ছিলেন অভিনেতা, সাংবাদিক ও লেখক। ১৯৭১ সালে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে পাকসেনারা নির্মমভাবে হত্যা করার পর পুরো পরিবারটি বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ছিলেন ভাষা আন্দোলনের প্রবক্তা। এজন্যে পাকিস্তানিরা তাঁর ওপর অত্যন্ত ক্ষুব্ধ ছিল। প্রতীতি দেবী ছিলেন লেখক এবং কন্ঠশিল্পী। তিনি আমৃত্যু ঢাকার মগবাজারে কন্যা আরমা দত্তের সঙ্গে বসবাস করে গেছেন। ২০২০ সালের ১২ জানুয়ারি ৯৫ বছর বয়সে প্রতীতি দেবী ঢাকার বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রয়াত হন।

ঋত্বিককুমার ঘটক ছিলেন প্রচলিত সময়ের চাইতে অগ্রবর্তী ও বহুমাত্রিক একজন শিল্পস্রষ্টা। একই সঙ্গে তিনি পুরাণকে এবং প্রাচীন ও নিকট অতীতকে ধারণ করেছেন তাঁর সাহিত্যে, নাটকে চলচ্চিত্রে। ক্রমশ তিনি আবিষ্কৃত হচ্ছেন নিত্য নতুনভাবে। তাঁকে নিয়ে গবেষণা শুরু হয়েছে অনেক আগে থেকে যা অব্যাহত রয়েছে এবং থাকবে। যদিও দুর্ভাগা ঋত্বিকের ১৯৫২ সালে সমাপ্ত করা প্রথম ছবি ‘নাগরিক’ মুক্তি পায় তাঁর মৃত্যুর এক বছর পর ১৯৭৭ সালে। উস্তাদ আলাউদ্দিন খানকে নিয়ে করা প্রামাণ্যচিত্রটির টাইটেল থেকে আশ্চর্যজনকভাবে ঋত্বিকের নামটি বাদ দেয়া হয় যদিও এ ছবির চিত্রনাট্য রচনা ও পরিচালনার কাজ ঋত্বিকেরই করা।

ঋত্বিকের অকাল প্রয়ানের পর আয়োজিত স্মরণসভায় সত্যজিৎ রায় বলেছিলেন, ‘…..যাঁরা তাঁর সঙ্গে কাজ করেছে তাঁদের মুখে শুনেছি যে, সে কাজ করার সময়ও, অনেক সময়ই অসুস্থ থাকতো। কিন্তু আমার কাছে যেটা সবচেয়ে আশ্চর্য লেগেছে যে, তাঁর কোনো ছবি দেখে কখনও মনে হয়নি সেই অসুস্থতা এতটুকুও এতটুকুও সেই ছবির মধ্যে সঞ্চারিত হয়েছে।…

ঋত্বিক মনে প্রাণে বাঙালি পরিচালক ছিল, বাঙালি শিল্পী ছিল–আমার থেকেও অনেক বেশি বাঙালি। আমার কাছে সেইটেই তাঁর সবচেয়ে বড় পরিচয় এবং সেইটেই তাঁর সবচেয়ে মূল্যবান এবং লক্ষনীয় বৈশিষ্ট্য।’

জন্মশতবর্ষের এই পুণ্যলগ্নে ঋত্বিক ও প্রতীকির প্রতি আমাদের সশ্রদ্ধ ও সকৃতজ্ঞ ভালোবাসা।

চট্টগ্রামে ঋত্বিক জন্মশতবর্ষ উদযাপন অনুষ্ঠানমালা

চট্টগ্রাম ফিল্ম ইনস্টিটিউট ও আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ চট্টগ্রামের যৌথ উদ্যোগে আগামী ৭, ৮ ও ১৪ নভেম্বর চট্টগ্রাম আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ মিলনায়তনে ঋত্বিক জন্মশত বর্ষ উদযাপন উপলক্ষে চলচ্চিত্র প্রদর্শনী স্মরকগ্রন্থ ও বিভিন্ন প্রকাশনা এবং ঋত্বিক স্মারক বক্তৃতার আয়োজন করা হয়েছে। ৭ ও ৮ নভেম্বর বিকেল ৫ টায় প্রদর্শিত হবে যথাক্রমে মেঘে ঢাকা তারা ও তিতাস একটি নদীর নাম এবং ১৪ নভেম্বর বিকেল ৫ টায় অনুষ্ঠিত হবে ঋত্বিক ঘটক স্মারক বক্তৃতা। স্মারক বক্তৃতায় মূল প্রবন্ধ পাঠ করবেন বিশিষ্ট কবি, কথাসাহিত্যক ও চলচ্চিত্র বিশেষজ্ঞ আলম খোরশেদ। উৎসব উপলক্ষে ইনস্টিটিউটের মুখপত্র ডিপ ফোকাস ও বুলেটিন চিত্রপটের ঋত্বিক স্মারক সংখ্যা প্রকাশিত হবে। উৎসব ও স্মারক বক্তৃতা সবার জন্যে সবান্ধবে উন্মুক্ত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *