অনুর কাছে ‘নদী’ মানেই অন্যরকম আনন্দ। ‘নদী’ শব্দটা শুনলেই তার মন আনন্দে নেচে ওঠে। চোখের সামনে ভাসে নদীতে সাঁতার কাটা, নৌকায় ঘুরে বেড়ানোর দৃশ্য। স্কুল বন্ধে, কিংবা ঈদের ছুটিতে দাদুবাড়িতে বেড়াতে যাওয়া মানেই নদীর সঙ্গে জীবনযাপন। ‘নদী’ সম্পর্কে প্রথম ধারণা সে তার দাদার কাছ থেকেই পায়। দাদা তাকে নদীতে নামিয়ে বলেছিলেন, ‘দাদুভাই, এই আমাদের চাঁদরুপালি নদী। এই নদীর সাথে আমার বাবার, বাবার-দাদার আত্মার সম্পর্ক ছিল। আজ থেকে আমাদের মতো তুমিও চাঁদরুপালির আপনজন।’ অনুর বয়স তখন সাত কী আট বছর হবে। এরপর থেকে দাদার কাছ থেকে নদী সম্পর্কে নানান গল্প শোনে। মাঝে মাঝে তার বাবাও চাঁদরুপালির গল্প বলেন। নদীর স্পর্শে বেড়ে ওঠার গল্প। সেই থেকে ধীরে ধীরে চাঁদরুপালির সঙ্গে মায়ার বন্ধন তৈরি হয় অনুর।
অনুদের বাড়ি থেকে চাঁদরুপালির দূরত্ব খুব বেশি নয়। দোতলা বাড়ির ছাদে ওঠলেই ইঞ্জিনচালিত ছোট ছোট নৌকায় যাত্রী পারাপার, দিনভর জেলেদের মাছ ধরার কসরত চেখে পড়ে। চাঁদরুপালিকে ছাদ থেকে দেখতে দারুণ ভালো লাগে অনুর। বিকেলে একাই বাড়ির ছাদে ওঠে যায়, মৃদু বাতাসের ছন্দে চাঁদরুপালির রূপ দেখে মুগ্ধ হয়। কখনো তার মনে হয় কাছ থেকে নয়, দূর থেকেই চাঁদরুপালি দেখতে অনেক সুন্দর!
আজ স্কুল থেকে ফিরে ঘটনাটি জানার পর থেকে চাঁদরুপালির কথা খুব মনে পড়ছে অনুর। প্রচণ্ড মন খারাপ হয়ে আছে তার। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলো তাও কিছুই খাচ্ছে না সে। এরমধ্যে দুই-তিনবার মা এসে খেতে বলেছেন, তাও যাচ্ছে না। মেয়ের মন ভালো নেই বুঝতে পেরে মা বার বার কাছে আসেন, জানতে চান-কী হয়েছে, মন খারাপ, না শরীর খারাপ? খেতে আসছো না যে?
অনু চুপ করে আছে। কোনো উত্তর দেয় না। মেয়ের এমন আচরণে কিছুটা বিরক্ত হয়ে অন্য রুমে চলে যান তিনি।
মায়ের প্রশ্নের কোনো জবাব না দিলেও আড় চোখে তার চলে যাওয়াটা খেয়াল করে অনু। তারপর পাশে থাকা পত্রিকাটা হাতে নিয়ে আবার চোখ বোলায়। পত্রিকা পড়ছে আর রাগে কাঁপছে। স্কুল থেকে ফেরার পর পত্রিকায় প্রথম যখন সংবাদটা দেখেছিল, তখন থেকেই তার মনে অনেক প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। কিন্তু সেটি মাকে বলছে না। তার ধারণা বাবা ছাড়া তার এই দুঃখ-কষ্ট কেউ বুঝবে না। তাই অপেক্ষা করছে বাবার জন্য।
অপেক্ষা করতে করতে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমেছে। ক্লান্ত শরীরে ছোট্ট অনু ঘুমিয়ে পড়ে ড্রয়িং রুমের সোফায়। রাত ৯টায় বাসায় ফেরেন বাবা। দেখেন, মেয়ে ঘুমিয়ে আছে। কিছুটা অবাক হলেন! অনুর মায়ের কাছে জানতে চাইতেই তিনি বলেন, স্কুল থেকে ফেরার পর হাসিখুশিই দেখেছি। ড্রয়িং রুমে বসে পত্রিকা পড়ছিল। তারপর থেকে অন্যরকম আচরণ করছে। এখন পর্যন্ত কিছুই খায়নি। পানিও নয়। কিছু বলছেও না। বাবা মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে ডাক দেন। বাবার ডাকে ঘুম ভাঙে মেয়ের। ধীরে ধীরে চোখ খুলে বাবার দিকে তাকায়। তারপর বাবাকে জড়িয়ে কান্না শুরু করে। সে কী ভীষণ কান্না। মেয়ের কান্না দেখে বাবা অবাক! কী হয়েছে জানতে চান বাবা।
অনু কাঁদতেই থাকে। কিছুই বলে না, বলতে পারে না।
বাবা বুকে টেনে নিয়ে কান্না থামান। এরপর অনু বলতে শুরু করে, বাবা ওরা চাঁদরুপালিকে মেরে ফেলছে, ওকে বাঁচাও। বাঁচাও বাবা।
চাঁদরুপালির কী হয়েছে? আমাদের চাঁদরুপালি নদী?
– হ্যাঁ বাবা। বাড়িতে গেলে যে নদীতে সাঁতার কাটি, নৌকায় ঘুরে বেড়াই। যে নদীটা দাদুর অনেক প্রিয় ছিল। সেই নদীটাকে কারা যেন মেরে ফেলছে! মাটি দিয়ে ভরাট করে দিচ্ছে। নদীর বুকে বড়ো ফ্যাক্টরি করবে। তুমিই বলো বাবা এটা কি ঠিক হচ্ছে? ওকে যে মেরে ফেলছে, ওর কি কষ্ট হচ্ছে না? ওর কি কান্না পাচ্ছে না?
মেয়ের কথা শুনে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন বাবা। মনে পড়ে, কিছুদিন আগেই চাঁদরুপালি দখলের খবর পেয়েছিলেন বাড়ি থেকে, ছোট ভাই ফোন করে জানিয়েছিল। তখন তাঁর মধ্যে তেমন কোনো অনুভূতি তৈরি হয়নি। অথচ এই নদীতে তার নিজেরও অগনিত স্মৃতি জড়িয়ে আছে। এখন মেয়ের কথায় চাঁদরুপালির প্রতি তাঁর টান অনুভূত হচ্ছে। গভীর টান।
মেয়ে বলে, বাবা চলো আমরা গ্রামে যাই, গ্রামের মানুষকে নিয়ে চাঁদরুপালির পাশে দাঁড়াই। ওকে বাঁচাই। চাঁদরুপালি না বাঁচলে আমরা বাঁচবো না বাবা, আমাদের পরিবেশ-প্রকৃতি বাঁচবে না বাবা।
-হ্যাঁ চলো, কাল সকালেই আমরা গ্রামে যাবো চাঁদরুপালিকে বাঁচাতে!