গানের পাখি সাবিনা ইয়াসমিন

যে সময়ের কথা বলছি, সে সময় চলচ্চিত্রের অনেকেই আমাদের বাসায় আসতেন। নিয়মিত যারা আসতেন তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার খান আতাউর রহমান। তিনি ব্যক্তিগতভাবে সাতটি গুণে গুণান্বিত ছিলেন। ছিলেন পরিচালক, প্রযোজক, গীতিকার, সুরকার, অভিনেতা, চিত্রনাট্যকার ও গায়ক। সম্ভবত এ জন্যই তাঁর প্রোডাকশন হাউসের নাম ছিল ‘সেভেন আট’। খান আতা আমার আব্বা ফজলুল হকের সঙ্গে নানা রকম গল্প করতেন। আব্বাও চলচ্চিত্র পরিচালক ছিলেন। ‘সিনেমা’ নামক একটি পত্রিকাও সম্পাদনা করতেন। যার সুবাদে চলচ্চিত্রের মানুষের সঙ্গে সখ্য ছিল। একদিন খান আতা এসে আব্বাকে বললেন, আজ একটা গান রেকর্ডিং করলাম– দারুণ হয়েছে গানটা। 

গানটি কে গেয়েছে? আমার আব্বা জানতে চাইলেন। খান আতার জবাব, তুমি চিনবে না– তবে সম্পর্কে আমার শ্যালিকা। ‘বাহ ভালো তো শ্যালিকাকে দিয়ে গান করালেন’। 

শ্যালিকা কিন্তু অনেক ছোট। এত ছোট যে, সে যখন গান করতে মাইক্রোফোনের কাছে এলো তখন তার পায়ের নিচে টুল দিয়ে দাঁড় করাতে হয়েছে। এটা শুনে দারুণ কৌতূহল নিয়ে আব্বা জানতে চাইলেন শিল্পীর নাম কি? বললেন– ‘সাবিনা ইয়াসমিন’। 

ওই সময়ে আব্বার মুখ থেকে প্রথম সাবিনা ইয়াসমিনের নাম শুনি। তবে মনে রাখার মতো নয়। শুধু সেই ঘটনাটাই আমার মনে রয়েছে। এ রকম আরেকটি স্মৃতিময় ঘটনা রয়েছে সাবিনা ইয়াসমিনকে নিয়ে। আব্বার সঙ্গে সিনেমার আরেকজন দেখা করতে আসতেন। নাম কিউএম জামান। তিনি পেশায় ব্যবসায়ী হলেও ছিলেন ক্যামেরাম্যান ও পরিচালক। তাঁর স্ত্রী বিখ্যাত নায়িকা সুলতানা জামান। তখন আমাদের বাসা ছিল তেজতুরি বাজারে। সংগত কারণেই যারা এফডিসিতে যেতেন তাদের অনেকেই আমাদের বাসা হয়ে যেতেন। বাসায় আসা মানেই আম্মার হাতের সুস্বাদু রান্না খেয়ে যাওয়া। কথা প্রসঙ্গে জামান সাহেব আব্বাকে বললেন, আজ বেশ সমস্যায় আছি। আব্বা বললেন– কেন? তিনি বললেন, পিয়ানো দিয়ে গান গেয়েছে নায়িকা… তো! আর বলো না তোমার ভাবি শুটিংয়ে একটু বাইরে আছে। কিন্তু আমার ‘মনের মতো বউ’ ছবিতে ‘একি সোনার আলোয় জীবন ভরিয়ে দিলে…’ গানের দৃশ্যের শুটিং রয়েছে। পিয়ানো বাজানো দৃশ্যের হাতের কসরত লাগবে।

আপনারা হয়তো দেখে থাকবেন গানটির শুরুতে সুলতানা জামান পিয়ানো বাজিয়ে গান গাইছেন, সেখানে যে হাতটি দেখেছেন সেটি ছিল আসলে সাবিনা ইয়াসমিনের হাত। ঘটনাচক্রে আমারও ঘটনাটি শোনা হয়ে গেল। 

সাবিনা ইয়াসমিন গান গাওয়া ছাড়াই আমার কাছে উপস্থাপিত হলেন। গানের জন্য যে ত্যাগ, পরিশ্রম সবই করেছেন তিনি। তিনি এমন একজন শিল্পী যিনি তাঁর প্রতিভাকে তুলে দিতে চান নতুন প্রজন্মকে। তাই তিনি যখন চ্যানেল আইয়ের ‘সেরা কণ্ঠে’র বিচারক থাকেন তখন অন্য বিচারকদের সঙ্গে তুমুল আলোচনা করেন। কাকে শ্রেষ্ঠ শিল্পী নির্বাচিত করা যায়, ভবিষ্যতে কে ভালো গান করবে। কোনাল, ঝিলিক নাকি ইমরান! তিনি খুঁজে খুঁজে শ্রেষ্ঠ প্রতিভাকে মূল্যায়ন করেন। 

‘সেরা কণ্ঠ’ আয়োজন করতে গিয়ে খুব কাছ থেকে দেখেছি সাবিনা ইয়াসমিনকে। তাঁর সম্পর্কে আরও উচ্চ ধারণা হয়েছে। তিনি যাদের মূল্যায়ন করেছেন তারাই পরবর্তী জীবনে বড় শিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে চলেছে। সাবিনা আপা অত্যন্ত গুণী এবং অনেক বড় মাপের শিল্পী। আমাদের চলচ্চিত্রের হাজার হাজার গান তাঁর কণ্ঠে প্রাণ পেয়েছে। শহর থেকে গ্রাম, দেশ থেকে বিদেশে– সবখানেই তাঁর জনপ্রিয়তা। মানুষের অন্তরে তিনি পৌঁছে গেছেন অনন্য উচ্চতায়। 

সাবিনা আপা চকলেট ভালোবাসেন। ছোটদের মতো তিনি চকলেট খান। অনেকেই শুনে অবাক হবেন আইস্ক্রিমও তাঁর খুব প্রিয়। যার কণ্ঠের যত্ন নেওয়ার জন্য ঠান্ডা খাওয়া মানা তিনি আইস্ক্রিমও খান। তবে পরিমিত। তিনি বুঝতে পারেন তাঁর শরীরে কতটুকু প্রয়োজন। প্রয়োজনের অতিরিক্ত কিছুই খান না। খুব সুন্দর করে শাড়ি পরেন। তাঁর রঙের পছন্দ নিয়ে আমি অনেককে কথা বলতে শুনেছি। দুই বাংলায় তিনি যে পরিমাণ গান করেছেন সেই পরিমাণ গান আর কেউ গেয়েছেন কিনা আমাদের জানা নেই। কিন্তু এটা নিয়ে কোনো অহংকার নেই। একজন সরল প্রকৃতির মানুষ তিনি। একেবারে শিশুর মতো। পুরোটাই আটপৌরে বাঙালি। আমরা তাঁকে বলি গানের পাখি। 

তিনি যখন অসুস্থ হলেন তখন তাঁকে খুব কাছ থেকে দেখেছি। দেখেছি তাঁর মনোবল। সিঙ্গাপুরের ডাক্তাররাও বলেছিলেন, সাবিনা ইয়াসমিন তাঁর মানসিক শক্তি দিয়ে লড়াই করেছেন ক্যান্সারের মতো কঠিন ব্যাধির সঙ্গে । ওষুধের পাশাপাশি মানসিক শক্তিটাও অনেক গুরুত্বপূর্ণ। সাবিনা আপার মেয়ে বাঁধন মায়ের পাশে থেকে সাহস জুগিয়েছে। সেবা করেছে। আমরা দেখেছি, সেই সংগ্রামে তিনি জয়ী হয়ে ফিরে এসেছেন। 

সাবিনা আপাকে নিয়ে লিখতে গেলে অনেক বড় লেখা হয়ে যাবে। তাঁর সম্পর্কে জানে না এমন মানুষ খুব কমই। বাঙালি মাত্রই গান ভালোবাসে। কথায় আছে– ‘বাঙালির গোলা ভরা ধান আর গলা ভরা গান’। অনেক জনপ্রিয় গানের তালিকায় সাবিনা ইয়াসমিনের গানগুলো অগ্রভাগে থাকবে। একবার চ্যানেল আইয়ের জন্য তিনি রবীন্দ্রসংগীত গাইলেন। কোথাও হয়তো তিনি নজরুল সংগীতও গেয়েছেন নিশ্চয়। এটাই সাবিনা ইয়াসমিন। তাঁর কণ্ঠে জাদু আছে। তিনি যে লিরিকেই কণ্ঠ দেন সেটি মধুর গীত হয়ে যায়। তাঁর কণ্ঠের জাদুকরী ছোঁয়ায় দর্শক আন্দোলিত হয়। 

সম্প্রতি সাবিনা ইয়াসমিনের জীবন, কর্ম ও সংগীত নিয়ে আমাদের চ্যানেল আইয়ের বার্তাপ্রধান ও পরিচালক গণমাধ্যমব্যক্তিত্ব শাইখ সিরাজ একটি ডকুফিল্ম বানিয়েছেন। এর নাম দিয়েছেন ‘জুঁইফুল’-সাবিনা ইয়াসমিন। এতে উঠে এসেছে সাবিনা ইয়াসমিনের জীবনের জানা-অজানা নানা অধ্যায়। ডকুফিল্মটি দেখলে দর্শকশ্রোতা সাবিনা সম্পর্কে অনেক কিছু জেনে মুগ্ধ হবেন। 

সাবিনা আপা খুব সুন্দর করে বিনয়ীভাবে কথা বলেন। সাবিনা আপা যখন আমার স্ত্রী কনা আর তাঁর বান্ধবীদের সঙ্গে গল্প করেন, তখন নানা প্রসঙ্গে তাদের আনন্দ দেন। সাবিনা আপা ক্যান্সারের মতো কঠিন ব্যাধি নিয়ে জীবনের সঙ্গে সংগ্রাম করে বেঁচে রয়েছেন। এটা ভাবলে অবাক হই। এখনও তিনি দেশ-বিদেশে তাঁর ভক্তদের সংগীতের মূর্ছনায় ভরিয়ে রেখেছেন। তিনি যে মনের জোরে চলেন সেটা দেখিয়ে দিয়েছেন। মানুষের ইচ্ছেশক্তি থাকলে অনেক কিছুই জয় করা সম্ভব। আজ তাঁর জন্মদিন। কিন্তু কততম জন্মদিন সেটা বলব না। তিনি মনের শক্তি নিয়ে আমাদের ভেতর থাকবেন। আরও অনেক অনেক দিন আমরা তাঁর গান শুনব। এই প্রত্যাশা– সাবিনা আপা ভালো থাকবেন। 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *