আমি

হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুর পর এক যুগেরও বেশি সময় কেটে গেলেও তাঁর একাধিক রচনা এখনও অগ্রন্থিত রয়ে গেছে। কিছুদিন আগে বাংলাদেশের একাধিক দৈনিক পত্রিকার গত শতকের আশির দশকের সংখ্যাগুলো ঘাঁটতে গিয়ে খোঁজ পাওয়া গেল তাঁর ঠিক তেমনই একটি চমৎকার লেখার। ১৯৮৪ সালের সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর, এই তিন মাসের সংক্ষিপ্ত পরিসরে ‘দৈনিক বাংলা’র শুক্রবারের সাহিত্যপাতায় ‘আমি’ শিরোনামে একটি কলাম প্রকাশ পেত। নিজের লেখালিখির জগৎ ও ব্যক্তিসত্তা নিয়ে সেখানে প্রতি সপ্তাহে লিখতেন বাংলাদেশের কোনো বিখ্যাত লেখক। কারও লেখারই কোনো আলাদা শিরোনাম থাকত না। হুমায়ূন আহমেদের নিম্নোক্ত অগ্রন্থিত রচনাটিও প্রকাশ পায় ওই ‘আমি’ কলামেরই একটি কিস্তি হিসেবে, ১৯৮৪-র ১২ অক্টোবরে। 

আমি তখন খুব ছোট। টু-থ্রিতে পড়ি। একদিন বাসায় ফিরে দেখি দারুণ উত্তেজনা চারদিকে। কালোমতো একজন লুঙ্গিপরা লোক চিৎ হয়ে শুয়ে। আমাদের কাজের ছেলেটি তার সারা গায়ে প্রবল বেগে তেল মালিশ করছে। বাবা অফিসে যাননি (খুবই অস্বাভাবিক ঘটনা)। মা পোলাও-টোলাও রান্না করছেন (এটিও ব্যতিক্রমী বলার অপেক্ষা করে না)। জানা গেল আচারের মতো সারা গায়ে তেল মেখে যিনি বসে আছেন তাঁর নাম রওশন ইজদানী– একজন পল্লীকবি (আদমজী পুরস্কারে কবিকে ১৯৬০ সনে সম্মানিত করা হয়)। কোনো কবি বা লেখকের সঙ্গে সেটিই আমার প্রথম পরিচয়। কেউ যেন মনে না করেন সেই পরিচয়ের ফলেই আমার মনে লেখক হবার ইচ্ছা জাগে। আমার গল্প-উপন্যাস লেখা একটি আকস্মিক ঘটনা। কবি রওশন ইজদানীর উল্লেখ করছি সম্পূর্ণ ভিন্ন কারণে।
এই কবি যে ক’দিন আমাদের বাসায় ছিলেন সেই ক’দিন আমরা নিচু গলায় কথা বলতাম, হৈ চৈ চিৎকার সম্পূর্ণ বন্ধ। কারণ কবির মনে ‘ভাব’ এসে গেছে বা আসবে আসবে করছে এ সময় চারদিকে অখণ্ড নীরবতা প্রয়োজন। এই ভাবের ব্যাপারটি নিয়েই ‘আমি’ প্রসঙ্গ শুরু করি। আমার মধ্যে ভাব-টাব কিছু নেই। কখন ভাব আসবে তার জন্যে অপেক্ষা করি না। সময় পেলেই লিখতে বসি। এবং যখন লিখি তখন চারপাশের হৈ চৈ চিৎকার কিছুই আমাকে স্পর্শ করে না। অনেকবার আমার সন্দেহ হয়েছে আমি বোধ হয় সত্যিকার লেখক না। সত্যিকার লেখকরা নিশ্চয়ই যখন তখন লেখা নিয়ে বসেন না। যে জিনিস তৈরি হয় মনে, তার জন্যে অবশ্যই মানসিক প্রস্তুতি প্রয়োজন। আমার নিজের মধ্যে হয়তো এসবের কোনো বালাই নেই। প্রথম দু পাতা কষ্ট করে লিখি তারপর আর কোনো কষ্ট নেই। গল্পই গল্পকে টেনে নিয়ে যায়। আমাকে কলম ধরে বসে থাকা ছাড়া আর প্রায় কিছুই করতে হয় না। 
লেখাতে আমার প্রচুর সেন্টিমেন্টালিটি, প্রচুর আবেগ। ব্যক্তিগত জীবনে সে সব জিনিসের আমার বেশ অভাব আছে। আমার গল্প-উপন্যাসের বেশির ভাগ নায়কই জ্যোৎস্না দেখে আবেগে আপ্লুত হয়। আমি নিজে কখনো হই না। তাহলে কি লেখার সঙ্গে আমার হৃদয়ের যোগ তেমন নেই? নানান রকম প্রশ্ন আমার মনে। লেখা ব্যাপারটি কী? কেন আমি লিখি? এই যে এত লেখা লিখলাম, এর কি কোনো স্থায়ী মূল্য আছে? সাহিত্যের মর্জিনারা ‘ঘরমে এত্তা জঞ্জাল’ বলে এদের ডাস্টবিনে নিক্ষেপ করবে না কি? অবশ্যি এইসব ব্যাপার আমাকে কখনোই বিশেষ বিচলিত করে না। লেখা আমার কাছে দারুণ একটা আনন্দের ব্যাপার। 
এই আনন্দের উৎস কী? উত্তর আমার জানা নেই। জানতে ইচ্ছে করে। আমার ছোট বোন (সাহিত্যের অধ্যাপিকা) আমাকে সাহিত্যের বোধ দেয়ার প্রচুর চেষ্টা করেছে এবং করছে। তার ঠেলাঠেলিতে সাহিত্য সম্পর্কে নিজের অনিচ্ছাতেও পড়তে হয়েছে। আর্ট ব্যাপারটি কী? ‘উচ্চ অঙ্গে আর্টের উদ্দেশ্য নয় দুই চক্ষু জলে ভাসিয়ে দেওয়া– ভাবাতিশয্যে বিহ্বল করা। তার কাজ হচ্ছে মনকে সেই কল্পলোকে উত্তীর্ণ করে দেওয়া, যেখানে রূপের পূর্ণতা।’ লিখবার সময় এইসব কথা আমার মনে থাকে না। আমি লিখি নিজের আনন্দের জন্যে। লেখাটি নবম শ্রেণির বালিকাদের উপযোগী হয়েছে কি সাহিত্যের অধ্যাপিকাদের ভাবিত করবে তা নিয়ে মোটেও মাথা ঘামাই না। সমালোচকরা যখন বলেন– ‘আপনার লেখাগুলি হচ্ছে ভাবালুতা, এর কোনো স্থায়ী মূল্য নেই।’ আমি তৎক্ষণাৎ বলি পৃথিবীতে কোনো কিছুরই কোনো মূল্য নেই। পৃথিবী সমকালীন। যখন আমি থাকব না, তখন যেন আমার সাহিত্যও না থাকে। 
আমি প্রচুর পড়ি। সে পড়াও কাজের পড়া নয়। নিজের আনন্দের জন্যে পড়া। কিছু লেখার জন্যে কখনো কিছু পড়েছি বলে মনে পড়ে না। আমি হচ্ছি সেইসব মূর্খদের দলে যারা মনে করে কেউ তাদের কিছু শেখাতে পারে না। আমার কাছে ‘পদ্মানদীর মাঝি’র চেয়ে ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’ অনেক প্রিয়। গোর্কির চেয়েও জন স্টেইনবেককে বেশি ভালো লাগে। জীবনের বাস্তবতার চেয়েও রহস্যময়তা আামর কাছে অনেক আকর্ষণীয় মনে হয়। কল্পনাশ্রয়ী বিষয় আমাকে তীব্রভাবে আকর্ষণ করে। সায়েন্স ফিকশন এবং ফ্যান্টাসির আমি একজন বড় ভক্ত। নিজেও দুটি সায়েন্স ফিকশন লিখেছি– ‘তোমাদের জন্যে ভালোবাসা’ ও ‘তারা তিনজন’। আরও লিখব। 
আমি কাদের নিয়ে লিখি? অবশ্যই যারা আমার চারপাশে আসে তাদের নিয়ে। এদের আমি চিনি। এদের দুঃখকষ্ট আমি বুঝতে পারি। যে দরিদ্র মাঝিটি গ্রামের ছোট্ট নদীর পাশে নৌকা বেঁধে সন্ধ্যাবেলায় ভাত রাঁধতে বসেছে ওর দুঃখ আমি জানি না। ওর গভীর দুঃখের কথা সে কারণেই লেখা হয় নাই। 
পৃথিবীটাকে কখনোই আমার কাছে খুব বাস্তব মনে হয়নি। আমার কাছে বেঁচে থাকা, প্রেম-ভালোবাসা, আশা-আকাঙ্ক্ষা সবকিছুই বেশকিছু পরিমাণে ‘আনরিয়েল’ বলে মনে হয়। সব সময় চেষ্টা করি লেখাতে সেটি তুলে আনতে। কখনো পারি না। হয়তো, পারব। হয়তো পারব না।
তবে কিছু পরিবর্তন হচ্ছে আমার মধ্যে। হঠাৎ করেই, নিজের বৃত্তের বাইরের জীবন, ভাটি অঞ্চল নিয়ে লিখলাম ‘ফেরা’। কেন লিখলাম? লিখেছি কারণ ইদানীং বুকের মধ্যে অন্য এক ধরনের কষ্ট অনুভব করতে শুরু করেছি। কল্পনার কষ্ট নয়। খুবই বাস্তব কষ্ট। মনে হচ্ছে লেখার ক্ষমতার (যদি কিছু থেকে থাকে) যথার্থ ব্যবহার করিনি। জীবনের চেয়ে জীবনের একটি রঙিন ছায়া আমাকে আকর্ষণ করেছে। প্রজাপতির পাখা নিয়ে লিখেছি। প্রজাপতিটি উড়ে গেছে। 
গত শীতে বরিশাল গিয়েছিলাম এমএসসি পরীক্ষা নিতে। খুব ভোরবেলা স্টিমার থেকে নেমে কলেজের দিকে যাচ্ছি। হঠাৎ দেখি ছোট্ট একটি মেয়ে গায়ে চট জড়িয়ে একা একা বসে শীতের যন্ত্রণায় থরথর করে কাঁপছে। ঠিক এর বয়সী আমার একটি মেয়ে আছে–বিপাশা আহমেদ। এই শিশুটির মুখ অবিকল আমার মেয়ের মুখের মতো। প্রথমবারের মতো আমি রাগে অন্ধ হয়ে প্রতিজ্ঞা করলাম, এরপর যদি লিখি শুধু এদের কথাই লিখব। তারপরও লিখেছি–‘সৌরভ’, ‘একা একা’ এবং ‘এই বসন্তে’। কিন্তু হায়, সেই শীতকাতর শিশুটির কথা কোথাও নেই। 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *