নভেম্বরে টরন্টোতে এমন শীত! শূন্যের নিচে আট-নয়। আবার তুষারপাত। এমনটা সাধারণত হয় না। তবে হচ্ছে, কী করবেন!
বাংলা টাউনে টরন্টো ফিল্ম ফোরাম সাপ্তাহিক শুক্রবারে একটি করে ফিল্ম দেখায়। মনিস রফিক ফোনে বিশেষ করে বলেছে– অবশ্যই আসবেন ইকবাল ভাই, ক্ল্যাসিক ওল্ড সিনেমা। হাঙ্গেরিয়ান পরিচালক মিকলস জ্যাঁকসোর ‘ওয়ে মাই হোম’। ১৯৬০-৬৫’র ফিল্ম।
আমার বদ অভ্যাস, যতই স্নো পড়ুক, তুষারঝড় শুরু হোক, তাতে গাড়ি চালাতে এই বয়সেও মজা লাগে। পৌঁছে গেলাম টরন্টো ফিল্ম ফোরাম অফিসের পেছনে পার্কিংয়ে পার্ক করে ঢুকলাম ভেতরে। দুই ঘণ্টা পরে তুষারে চাপা পড়বে গাড়ি। আধঘণ্টা পরিশ্রম করে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে বের করতে হবে।
শুরু হলো সাদাকালো সিনেমা। ৬৫ বছর আগের অথচ কী ভালো প্রিন্ট! দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের শেষ সময়, জার্মান হিটলার পরাজিত। হাঙ্গেরি মুক্ত তবে রাশান সৈন্যদের দাপট চারদিকে। ক্যামেরায়— বিরান প্রান্তরে বিশাল খামার। শ তিনেক বলিষ্ঠ গরু থাকে চরে খোলা আকাশের নিচে। তিন দিন পরপর বড় বড় সব ড্রামভর্তি দুধ রুশ সৈন্যদের জন্য যায় এই খামার থেকে। যুদ্ধের আঘাতে ভাঙা একটি ঘর, এই খোলা প্রান্তরে। কাজ দেখাশোনার জন্য রয়েছে এক অতিতরুণ রুশ সৈন্য। তাকে সাহায্য করতে আসে তারই বয়সী এক হাঙ্গেরিয়ান যুদ্ধবন্দি। যুদ্ধে অর্ধেক হাঙ্গেরির মানুষ হিটলারকে সমর্থন করেছিল। তারা এখন যুদ্ধবন্দি। দুজন সমবয়সী তরুণ কেউ পরস্পরের ভাষা জানে না। হঠাৎ পালাতে চাইল হাঙ্গেরিয়ান তরুণ। রুশ তরুণ সৈনিক মরিয়া হয়ে তাকে ঠেকাল। বোঝাল, ‘কোথায় পালাবে বন্ধু? চারদিকে মাইন পোঁতা।’ এই বৈরী প্রকৃতির মধ্যে খামারে সারাদিন মহা মহা পরিশ্রমের কাজ করতে করতে তাদের বন্ধু হয়ে যায়। রুশ সৈনিক পেট ব্যথায় সারাক্ষণ কষ্ট পেত। একদিন গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ল। বিরান প্রান্তর। দূরে যে রাস্তা দিয়ে ঘোড়ায়, গরুগাড়িতে শতশত শরণার্থী ফিরছে, সেখানে গিয়ে মেশিনগানের ভয় দেখিয়ে, একজন ডাক্তার ধরে আনে হাঙ্গেরিয়ান ছেলেটি। এসে দেখে, রুশ সৈন্যটি মরে পড়ে আছে।
ঠিক এখান থেকে আমার মন ঝাপসা হয়ে গেল। মন ঝাপসা হলে চোখে আর কিছু দেখা যায় না। আর তখনি শুরু হলো মস্তিষ্ক থেকে মনে, ফোঁটা ফোঁটা, স্মৃতির তুষারপাত। কোথায় এক রুশ সৈন্যের বিরান প্রান্তরে মৃত্যু, এর সঙ্গে আমার মায়ের মৃত্যুর আগমুহূর্তের কোথায় মিল? কেন আমি সিনেমার দৃশ্য ভুলে মনের চোখে দেখছি, মারা যাওয়ার আগে মৃদু দুর্বল স্বরে মা বলছে– ইকবাল আসছে? আনোয়ার আসছে?
অনেক আগে দেশে যেতে চট্টগ্রামে বাড়িতে মা বলেছিলেন– আমি হুট করে মারা যাব না! পাঁচ-সাত-দশ দিন মরণ যন্ত্রণায় ভুগব। ইচ্ছে করলে, তুমি বড় ছেলে, বিদেশ থেকে আসতে পার! তবে মা হিসেবে এটাও জানি, তুমি সুযোগ থাকলেও আসবে না! মায়ের কথাই ঠিক, যেতে পারতাম কিন্তু যাই নাই।
যেদিন মারা গেলেন সেই দুপুরে, আমার একমাত্র সন্তান কন্যা অগ্নিলা ও তার স্বামী নাবিল মুনতাসীর দুই পুঁচকে কন্যাকে নিয়ে লং উইকেন্ডে ভার্জিনিয়া থেকে টরন্টো, বাসায় এলো।
এগারোতলা বিল্ডিংয়ের নবম তলায় আমি ও আমার স্ত্রী শাহানা থাকি। মেয়ে খেয়ে চলে যাবে। আমি নিচে নেমে আন্ডারগ্রাউন্ড পার্কিংয়ে ওদের গাড়ি পার্ক করে নাতনিদের সঙ্গে খেলতে নবম তলায় উঠে এলাম। মেয়ে মাকে ভ্রমণের ভালো লাগা খারাপ লাগা বলে যাচ্ছে। আমার স্ত্রী জীবনের অনেকটা সময় বিশ্বব্যাংক, ঢাকায় চাকরি করতেন। বছরে একবার, এমনকি দুইবার অফিসের কাজে ওয়াশিংটনের হেডকোয়ার্টারে আসতেন। থাকতেন বন্ধুবান্ধবের বাসায় ভার্জিনিয়া বা মেরিল্যান্ডে। তাই আগ্রহ নিয়ে শুনছেন মেয়ের মুখে ভার্জিনিয়ার কথা। টেবিলে খাওয়া দেওয়া হয়েছে, সবাই খেতে বসেছে। আমার স্ত্রী পুরান ঢাকার জমিদার ঘরের মেয়ে হলেও রান্না করে দারুণ মজার। ভাত দিয়ে স্যামন মাছের কারি শেষ করে অগ্নিলা আমার দিকে তাকিয়ে বলল– কী হয়েছে বাবা? আজ তোমাকে স্যাড লাগছে একটু?
–গতকাল তোমার দাদি মারা গেছেন!
অগ্নিলা ফ্যালফ্যাল করে বেশ কয়েক মুহূর্ত আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বাথরুমের দিকে দৌড়ে কমোডে বমি করতে লাগল। হাতে পানি নিয়ে বাড়িয়ে দিতে এক ঝটকায় কাচের গ্লাস ছুড়ে ফেলে চুরমার করে দিল। বলল– তুমি সন্তান হয়ে এত স্বাভাবিক কেন!
প্রশ্নটা আমি নিজেকে বারবার করেও পাইনি। আমি কেন এমন? আর এক হাঙ্গেরিয়ান সিনেমায় তরুণ রুশ সৈন্যের মৃত্যু দেখে টিপটিপ করে ফোঁটায় ফোঁটায় মায়ের মুখ, মায়ের স্মৃতি ভেতরে গলে পড়ছে। মানুষ কি সব সময় সঠিক মুহূর্তে অনুভূতি দেখাতে পারে? পারে না। সেসব ভেতরে থেকে যায়। শুধু মা নয়, অন্য নারী কিংবা পুরুষের এমনতর সাধারণ অথবা অসাধারণ স্মৃতি আচমকা এমনি সময়ে-অসময়ে টিপটিপ করে পড়তে শুরু করে।
২. তখন আমি ঢাকায় বিটপী বিজ্ঞাপন কোম্পানিতে কাজ করতাম। বিখ্যাত ফটোগ্রাফার আনোয়ার হোসেন শুট করছেন। আমি সিনিয়র আর্ট ডিরেক্টর ছিলাম। শুটের কনসেপ্টটি আমার। আউটডোর শুটে আমিও ছিলাম। মডেল অতি সুন্দরী। আমার যেমনটি ভালো লাগে, স্লিম লম্বা, ডাগর চোখে কাজল, দীর্ঘ চুল। শুট শেষ হলো। মেয়েটি বাড়ি গিয়ে মেকআপ তুলবে। আমার মেয়ের চেয়ে হয়তো পাঁচ বছরের বড় হবে মেয়েটি তখন। কী নাম ছিল তার আজ মনে নেই। অফিসের যা গাড়ি ছিল তা দিয়ে সবাইকে নামানোর পর তাকে আশুলিয়ার পর ড্রপ করবে। সংকট। আমি বললাম– চিন্তা নেই, আমি আমার গাড়িতে তাকে নামিয়ে দিয়ে আসছি।
সবাই যার যার মতো চলে গেল। আমার পাশেই বসল মেয়েটি। হয়তো ড্রাইভার চালালে পেছনের সিটে বসত। আশুলিয়ার জলার মাঝ দিয়ে রাস্তা পার হচ্ছি আর অমনি ঝমঝম করে বৃষ্টি নামল। এমন বৃষ্টি যে সামনের গ্লাসের ওয়াইপার সমানতালে বৃষ্টির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পারছে না। হঠাৎ মেয়েটি বলল গাড়ি থামান সাইড করে। কেন বুঝলাম না। তবে থামিয়ে দিলাম গাড়ি। এক ঝটকায় দরজা খুলে মেয়েটি বেরিয়ে পড়েছিল বাইরে। ঝুমঝুম বৃষ্টিতে মেয়েটি দুহাত মেলে দিয়ে ভিজতে থাকল।
আমি গাড়ি থেকে নামি নাই। ভেতরে বসে এই দৃশ্য দেখেছি। গাড়ির পেছনে একটা বিরাট পলিথিন ছিল। বৃষ্টি থামতে সেটি পেছনের সিটে বিছিয়ে দিলাম। তার ওপর মেয়েটি ভিজে কাপড়ে বসে পড়ল। বাসার সামনে গাড়ি দাঁড় করাতে বিদায় নিয়ে চলে গেল। এরপর আর কখনও দেখা হয়নি। তবু সে রয়ে গেছে আমার মাথায়, বাষ্প হয়ে। কখনও হয়তো এমন সময়ে সেই স্মৃতি মনে পড়ে যখন মনে পড়ার কথাই নয়। দেশে আসার পথে একবার টরন্টোর পিয়ারসন এয়ারপোর্টে বসে আছি। কানাডার দারুণ মজার কফি ‘টিম হর্টন’। অনেকক্ষণ খেতে পাব না ভেবে এক কাপ নিয়ে হেঁটে হেঁটে বিশাল কাচের জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছি। বাইরে বৃষ্টি। বড় বড় অনেক প্লেন দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজছে। জার্মানির লুফথানসা আর এয়ার কানাডার দুই প্লেনের মাঝে বিরাট ফাঁকা জায়গা। সেই ফাঁকায়, স্পষ্ট দেখতে পেলাম, সেই মেয়েটি সেদিনের কাপড়ে দুহাত মেলে বৃত্তাকারে ঘুরছে।
৩. দেশে গিয়ে বিশেষ কিছু বন্ধুর বাসায় উঠি। বন্ধুদের একজন কিশওয়ার ইমদাদ, মেরী স্টোপস বাংলাদেশের কান্ট্রি ম্যানেজার। সেবার তার স্কুলপড়ুয়া ছেলে নিউইয়র্ক থেকে স্কুল ভ্যাকেশনে বাপের কাছে এসেছে বলে, উঠলাম কিশওয়ারের মায়ের বাড়ি উত্তরার পাঁচ নম্বর সেক্টরে। ছয়তলা বাড়ি, সেই বাড়ির ছাদে চিলেকোঠায় ব্যবস্থা হলো। সারা ছাদে গাছ আর গাছ। ফাঁকফোকরে ইজেল দাঁড় করিয়ে ছবি আঁকতাম। এমন ডে লাইটের খোঁজে ভিনসেন্ট ভ্যান গগ মাইলকে মাইল ঘুরতেন ছেঁড়া বুট পরে।
এক রাতের কথা। গুলশানের ইতালির রাষ্ট্রদূতের বাসায় জমজমাট পার্টি আর ফিল্ম শো ছিল। ফিরতে বেশ রাত হয়ে গেল। উবারে ফিরছি। রাত বেশি হলে উত্তরায় অনেক রাস্তা সিকিউরিটি গার্ডরা বন্ধ করে দেয়। ঘুরেফিরে দুই ধারে সব উঁচু উঁচু বিল্ডিংয়ের পেছনের সরু রাস্তা দিয়ে ফিরছি। হঠাৎ দেখি এক সাদা দাড়ি, লম্বা চুল নুরানি চেহারার বৃদ্ধ। কয়েকজন বখাটে ছেলে তাকে বিরক্ত করছে। আমি গাড়ি থামাতে বললাম। সাধারণত কেউ থামে না। ড্রাইভারও থামতে চাননি। শেষমেশ গাড়ি থামল। ছেলেগুলো ড্রাগের জন্য মিনিমাম এক হাজার টাকা চায়। আমি এক হাজার টাকার একটি নোট বের করে ছেলেগুলোকে দিয়ে ওনাকে গাড়িতে তুলে কাছেই এক বাড়িতে নামিয়ে দিলাম। বললেন, এই বাড়িটা তাঁর। বিল্ডার বানিয়ে দেওয়ার পর যে ক’টা ফ্ল্যাট পেয়েছিলেন ছেলেমেয়েদের মধ্যে ভাগবাটোয়ারা হয়ে গেছে। ভদ্রলোকের নাম বদরউদ্দিন উমর। শুনে কিছু বলতে গেলে নিজ থেকেই বললেন– “জি, এই নামে একজন বড় সাহিত্যিক না কে যেন আছেন।” আমি আর কথা বাড়ালাম না। সিকিউরিটি গার্ড তাকে দেখে গেট খুলে দিল। তিনি অনেক ধন্যবাদ দিয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকে গেলেন।
সপ্তাহখানেক পরে হেঁটে যাচ্ছিলাম বদরউদ্দিন উমরের বাড়ির সামনে দিয়ে, ভাবলাম খোঁজ নিয়ে যাই। গার্ড বলল এই নামের কেউ এখানে থাকে না। বিশ্বাস হলো না আমার, তাই সুপারকে ডেকে জিজ্ঞেস করলাম। তিনিও বললেন এই নামের কেউ এখানে থাকে না। মাসখানেক পরে আবার ওনার সঙ্গে দেখা হলো। গুলশান দুই নম্বরে ইউনিমার্ট মলের ফুডকোর্টে, বাইরে চেয়ার-টেবিলে বসে পিৎজা খাচ্ছেন। সামনে গিয়ে বসলাম। “সেই বাড়িতে যে তিনি থাকেন না, তাহলে কেন মিথ্যা কথা বললেন?” উনি পিৎজা মুখে পুরে কিছুক্ষণ চিবুলেন। এরপর বললেন– “ওরা আমার সঙ্গে এমনই করে। আমার অস্তিত্ব বিশ্বাস করে না।”
এরপর তার সঙ্গে আবারও দেখা হলো! সেবার মালিবাগ সোহাগ বাসের অফিসে। সাড়ে ১১টার বাসে চট্টগ্রাম যাচ্ছেন তিনি। আমি তো অবাক। আমিও যাচ্ছি চট্টগ্রামের বাড়িতে। আবার কথাবার্তা হতে লাগল। তিনি বললেন– “আপনার এক হাজার টাকা তো আমাকে ফেরত দিতে হবে।” এর মধ্যে তিনি একটা ওষুধ কিনতে আমাকে সঙ্গে নিয়ে মৌচাক মার্কেটে গেলেন। টুলে বসে চা খাওয়ালেন। চা শেষ করে মনে হলো যেন আমার কেমন একটা ঘোর লাগছে। কিছুক্ষণ পর দৌড়ে এসে দেখি টার্মিনালে সাড়ে ১১টার বাস নেই, চলে গেছে। ওরা পরের বাসে ব্যবস্থা করে দিল। আমার পাশেই বদরউদ্দিন উমরের সিট। হঠাৎ শুনি, সোহাগের যে বাস সাড়ে ১১টায় ছেড়ে গিয়েছিল, একটা ট্রাকের সঙ্গে সেটার মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়েছে। তিনজন প্যাসেঞ্জার মারা গেছেন। বৃদ্ধ লোকটা বললেন– “বেঁচে গেলাম!” একটু পরে বাস এসে থামল হাইওয়ে ইনে। সবাই নামল ফ্রেশ হতে, চা-পানি খেতে। আমি বাস থেকে নামার আগে বাস সুপারকে জিজ্ঞেস করলাম, “আমার পাশে যিনি বসেছিলেন, ওনার নাম কি বদরউদ্দিন উমর?” বাসের সুপার বলল– “কী যে বলেন আপনার পাশে তো খালি সিট, কেউ নেই।” কী বলে না বলে! আমার চা-পরোটা-ভাজি খাওয়া শেষ। বেরিয়ে এসে বাসে উঠতে যাব, দেখি অন্ধকার হাইওয়ে ধরে বৃদ্ধ হাঁটছেন। হুহু করে ট্রাক-বাস যাচ্ছে। যে কোনো সময় গাড়ি ওনাকে উড়িয়ে দিয়ে চলে যাবে। দেখলাম মুহূর্তেই যেন অনেকটা দূরে চলে গেছেন। একটা ট্রাক হুহু করে আসছে। তিনি যেমন হাঁটছিলেন তেমনি হাঁটছেন। দুর্ঘটনা এবার অবধারিত। আমার বিস্ফারিত চোখের সামনে ট্রাক তাকে চিরে চলে গেল। তার কিছুই হলো না!
দূর থেকে একবার আমার দিকে মুখ ঘুরিয়ে যেন হাসলেন। এরপর মিলিয়ে গেলেন। আমাকে প্রাণে বাঁচিয়ে দিয়ে তিনি চলে গেলেন।
কারা এরা? মানুষ নাকি অন্য কিছু কে জানে!