লেখাটি শুরু করতে চাই, যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত কার্নেগি মেলন বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রখ্যাত কম্পিউটার বিজ্ঞানী এডওয়ার্ড ফ্রেডকিন এর একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্ধৃতির মাধ্যমে। তিনি বলেছেন, মানব সভ্যতার ইতিহাসে তিনটি বিষয় বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমটি হলো মহাবিশ্বের সৃষ্টি, দ্বিতীয়টি হলো সেই মহাবিশ্বে জীবনের আবির্ভাব এবং তৃতীয়টি, যা এই দুই ঘটনার সমতুল্য গুরুত্ব বহন করে। তা হলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) আবির্ভাব। ফ্রেডকিনের কথায়, যখন কোনো প্রাকৃতিক জিনিসকে কৃত্রিমভাবে পুনর্র্নিমাণ করা হয়, তখন তা অনেক সস্তা হয়ে যায়, ব্যাপকভাবে উৎপাদনযোগ্য হয় এবং তার গুণগতমানও নিশ্চিত থাকে। স্বাভাবিকভাবেই, প্রাকৃতিক বুদ্ধিমত্তাকে প্রযুক্তির মাধ্যমে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় রূপান্তরিত করা গেলে, তা দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করার মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, যদি আমরা ভবিষ্যতের আবহাওয়ার পূর্বাভাসকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে সঠিকভাবে চালিত করতে পারি, তবে এটি কৃষিক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
বাংলাদেশের সামনে এখন একটি বাস্তব সুযোগ রয়েছে আঞ্চলিক পর্যায়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) নেতৃত্ব গড়ে তোলার। দেশের তরুণ জনসংখ্যা, দ্রæত বিকাশমান ডিজিটাল অবকাঠামো এবং স্থানীয় ভাষা ও খাতভিত্তিক সমস্যার সমাধানমুখী এআই উদ্ভাবনের সম্ভাবনা এই সুযোগকে আরও উজ্জ্বল করছে। তবে এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য দরকার একটি সুপরিকল্পিত জাতীয় কৌশল, ধারাবাহিক সরকারি বিনিয়োগ এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও শিল্প খাতের ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা।
মোবাইল ইন্টারনেটের প্রসার, ই-গভর্ন্যান্স উদ্যোগ এবং তরুণ প্রজন্মের উদ্যম ইতোমধ্যেই দেশের ডিজিটাল অর্থনীতির ভিত গড়ে তুলেছে। এই গতি যদি কৌশলগতভাবে কাজে লাগানো যায়, তবে বাংলাদেশ একটি এআই হাবে পরিণত হতে পারে। শিল্পে উৎপাদন খরচ কমানো, মান উন্নয়ন এবং প্রতিযোগিতা বাড়ানোর জন্য এআই হতে পারে দেশের অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি। তবে এর জন্য প্রয়োজন পরিকল্পিত পদক্ষেপ, সরকারি সহায়তা এবং একাডেমিক-শিল্প সহযোগিতা।
২০২৪ সালে যুক্তরাষ্ট্র এআই বিনিয়োগে শীর্ষে ছিল ১০৯ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলার। চীন বিনিয়োগ করেছে প্রায় ৯ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার, আর ভারত কেবলমাত্র জেনারেটিভ এআই স্টার্টআপ থেকেই কয়েকশো মিলিয়ন ডলার সংগ্রহ করেছে।
অন্যদিকে বাংলাদেশের আইসিটি রপ্তানি আয় এখনো ১ বিলিয়ন ডলারের নিচে। ব্যবধান স্পষ্ট হলেও তা অতিক্রম অযোগ্য নয়। বাংলাদেশের জনমিতিক সুবিধা এবং স্থানীয়করণকেন্দ্রিক সমাধান তৈরি করার ক্ষমতা আমাদের জন্য বিশেষ সুযোগ তৈরি করছে। বাংলা ভাষা প্রক্রিয়াজাতকরণ শিক্ষা ও জনসেবায়, এআই-চালিত নির্ভুল কৃষি, দুর্যোগ পূর্বাভাস, স্মার্ট গ্রিড ব্যবস্থাপনা, টেলিমেডিসিন, ঋণ স্কোরিং কিংবা ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা- সব ক্ষেত্রেই এআই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
এই মুহূর্তে সবচেয়ে জরুরি কাজ হলো একটি জাতীয় এআই মিশন গঠন করা। এতে বার্ষিক ৫০/১০০ মিলিয়ন ডলারের বাজেট, নির্দিষ্ট সূচক যেমন সরকারি এআই প্রকল্পের সংখ্যা, উন্মুক্ত বাংলা ডেটাসেট, প্রশিক্ষিত এমএসসি/ পিএইচডি স্নাতকের সংখ্যা এবং আন্তঃমন্ত্রণালয় সমন্বয় থাকতে হবে। দীর্ঘ গবেষণা অভিজ্ঞতা থেকে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, এই মিশনে কেবল অর্থায়ন নয় বরং নৈতিক ও ব্যাখ্যাযোগ্য এআই (এক্সপ্লেইনেবল এআই) বিকাশকে গুরুত্ব দিতে হবে, যা কৃষি, স্বাস্থ্য ও প্রশাসনে সরাসরি ব্যবহার করা যাবে বিশ্বস্ততার সাথে। একটি বিশেষায়িত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে, যেখানে বিভিন্ন খাতে স্থানীয় সমস্যার উদ্ভাবনী সমাধান নিয়ে অগ্রসরমান গবেষণা পরিচালিত হবে। স্বল্পমেয়াদী সমাধান হিসেবে দেশের শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কম্পিউটার সায়েন্স ও ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগগুলোতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিভিন্ন ক্ষেত্রে স্নাতকোত্তর গবেষণায় জোর দেওয়া।
বাংলাদেশে এআই স্টার্টআপ ও গবেষকরা বড় চ্যালেঞ্জের মুখে আছে তহবিল ও অবকাঠামোর ঘাটতির কারণে। সরকারকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা গবেষণায় বরাদ্দ বাড়াতে হবে এবং পাশাপাশি আরএন্ডডি ট্যাক্স ক্রেডিট, ক্লাউড ও কম্পিউট ভর্তুকি এবং স্টার্টআপ গ্র্যান্ট চালু করতে হবে। আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতায় আমি দেখেছি, উন্নত মানের ডেটা ও পর্যাপ্ত কম্পিউট ক্ষমতা ছাড়া উদ্ভাবন টেকসই হয় না। এজন্য প্রয়োজন বাংলা টেক্সট ও স্পিচ করপাস, কৃষি ও স্বাস্থ্য ডেটাবেস, এবং শক্তিশালী এচট ও ক্লাউড অবকাঠামো।
সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি। দেশি-বিদেশি এমএসসি ও পিএইচডি শিক্ষার্থীদের তত্ত¡াবধানের অভিজ্ঞতায় আমি দেখেছি, উন্নত শিক্ষা ও আন্তর্জাতিক সংস্পর্শই উদ্ভাবনী শক্তি গড়ে তোলে। বাংলাদেশকে আগামী পাঁচ বছরে ২০০/৫০০টি এআই-কেন্দ্রিক এমএসসি/ পিএইচডি বৃত্তি প্রদান করতে হবে। স্বাস্থ্য, কৃষি ও জলবায়ু এআই গবেষণায় অগ্রাধিকার দিতে হবে। একইসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ে টেক-ট্রান্সফার অফিস চালু করতে হবে, যাতে গবেষণা বাণিজ্যিক পণ্যে রূপ নিতে পারে।
সরকার স্থানীয় এআই সমাধানের প্রথম গ্রাহক হতে পারে। কর ব্যবস্থা, কাস্টমস, স্বাস্থ্যসেবা, কৃষি ও শিক্ষায় এআই প্রযুক্তি ব্যবহার শুরু করলে বাজার তৈরি হবে। একইসঙ্গে পোশাক, টেলিকম ও ফিনটেক খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো যৌথভাবে কনসোর্টিয়াম গঠন করে ডেটা ভাগাভাগি ও পাইলট প্রকল্প হাতে নিতে পারে। এতে স্টার্টআপের বাজার বিস্তৃত হবে এবং দ্রুত গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে।
এআই উন্নয়ন হতে হবে নৈতিকতা, গোপনীয়তা ও অন্তর্ভুক্তির ভিত্তিতে। এতে যেমন জনগণের আস্থা তৈরি হবে, তেমনি আন্তর্জাতিক সহযোগিতাও সহজ হবে। ইউনেস্কো, বিশ্বব্যাংক ও ইউএনডিপি’র মত সংস্থা এ ধরনের উদ্যোগে সহায়তা করতে আগ্রহী। আন্তর্জাতিক সহযোগিতার অভিজ্ঞতায় আমি দেখেছি, স্বচ্ছ ও দায়িত্বশীল নীতি দীর্ঘমেয়াদে টেকসই সফলতা আনে। বাংলাদেশকেও একই পথে এগোতে হবে।
অগ্রগতি মাপা উচিত এআই গবেষণায় বার্ষিক ব্যয়, প্রশিক্ষিত নতুন পেশাজীবীর সংখ্যা, এআই স্টার্টআপে বিনিয়োগ, উন্মুক্ত বাংলা ডেটাসেটের প্রাপ্যতা এবং সরকারি খাতে স্থানীয় এআই সমাধানের ব্যবহার দিয়ে। বাস্তবসম্মত লক্ষ্য হতে পারে আগামী পাঁচ বছরে আইসিটি রপ্তানি দ্বিগুণ করা এবং উল্লেখযোগ্য সংখ্যক এআই বিশেষজ্ঞ তৈরি করা।
বাংলাদেশ আপাতত ভারত বা চীনের সমপরিমাণ বিনিয়োগে সক্ষম নয়। তবে নেতৃত্ব মানে কেবল আকার নয়; বরং প্রাসঙ্গিকতা ও টেকসই সমাধান। একটি সুপরিকল্পিত মিশন, ধারাবাহিক বিনিয়োগ, দক্ষ মানবসম্পদ এবং একাডেমিয়া, শিল্প সহযোগিতা থাকলে বাংলাদেশ হতে পারে আঞ্চলিক এআই নেতৃত্বের দেশ। সময় এখনই, না হলে বৈশ্বিক এআই প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ার ঝুঁকি রয়েছে।
লেখক: ডিপার্টমেন্ট অফ কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং ফুলব্রাইট ভিজিটিং স্কলার প্রফেসর, ইউএসএ। বিশ্বের শীর্ষ দুই শতাংশ বিজ্ঞানীর একজন