হাওর ও খরাপ্রবণ বরেন্দ্র অঞ্চলে জলবায়ু সহনশীল জীবনমান গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে প্রস্তাবিত ‘জলবায়ু সহনশীল জীবনমান উন্নয়ন প্রকল্প (সিআরএলইপি)’ অনুমোদন দেয়নি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি একনেক। হাওর অঞ্চলের প্রকৃত চাহিদা অনুযায়ী অবকাঠামো নির্মাণের অংশ কমিয়ে প্রকল্প প্রস্তাব সংশোধন করে পরে উপস্থাপন করতে বলা হয়েছে। এর বাইরে বৈঠকে উপস্থাপিত বাকি ১৩টি প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয় বৈঠকে।
অনুমোদিত ১৩ প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছে এক হাজার ৯৮৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকারি অর্থায়ন এক হাজার ৮৮৫ কোটি টাকা। বিদেশি ঋণ নেওয়া হবে ৫৩ কোটি টাকা। বাকি ৫০ কোটি টাকা বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলো দেবে। অনুমোদিত প্রকল্পগুলোর মধ্যে তিনটি নতুন, সংশোধিত সাতটি ও ব্যয় বৃদ্ধি ছাড়া মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে বাকি তিনটি প্রকল্পের।
গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে পরিকল্পনা কমিশনের এনইসি সম্মেলন কক্ষে একনেক বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। উপস্থিত ছিলেন পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ, আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল, স্বরাষ্ট্র ও কৃষি উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী, শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান, বিদ্যুৎ ও সেতু উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান, স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া, স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম এবং পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন।
সাধারণত একনেক বৈঠক শেষে পরিকল্পনা উপদেষ্টা সাংবাদিকদের ব্রিফ করে থাকেন। কিন্তু পরিকল্পনা উপদেষ্টা অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ অসুস্থ থাকায় ব্রিফ করেননি। তবে পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা গেছে, বৈঠকে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান হাওর অঞ্চলের জন্য প্রস্তাবিত প্রকল্পের কাঠামো নিয়ে আপত্তি জানান। তিনি বলেন, জলবায়ু সহনশীলতার নামে প্রকল্পটিতে অবকাঠামো নির্মাণের দিকেই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। টেকসই জীবিকা উন্নয়ন ও দারিদ্র্য হ্রাসের বিষয়টি প্রায় উপেক্ষিত। উপদেষ্টার আপত্তির পর সভায় সিদ্ধান্ত হয়, হাওর অঞ্চলের প্রকৃত চাহিদা অনুযায়ী অবকাঠামো নির্মাণের অংশ কমিয়ে প্রকল্পটি পুনর্গঠন শেষে একনেকে উপস্থাপন করতে হবে।
হাওর এলাকায় অতিরিক্ত রাস্তা বা ভবন নির্মাণে দীর্ঘদিন ধরেই পরিবেশবিদরা উদ্বেগ জানিয়ে আসছেন। এতে বন্যা মৌসুমে পানি প্রবাহে বাধা সৃষ্টি হয়। এ কারণে কৃষিজমি ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং মাছের প্রজনন ব্যাহত হয়। এর বাইরে প্রকল্পের ব্যয় নিয়ে আপত্তি ওঠে একনেক বৈঠকে। পরিকল্পনা কমিশনের মূল্যায়নে দেখা যায়, প্রকল্পের প্রায় দুই-তৃতীয়ংশ অর্থ ব্যয় হবে সড়ক, ঘাট, বাজার ও আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণে। এসব বিবেচনায় অনুমোদন না দিয়ে অধিকতর যাচাই-বাছাই করে প্রকল্প প্রস্তাব পুনর্গঠনের নির্দেশ দেওয়া হয়।
কিশোরগঞ্জসহ আট জেলায় বাস্তবায়নের জন্য প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয় এক হাজার ২৬৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকারের দেওয়ার কথা ছিল ৩০৫ কোটি টাকা। আন্তর্জাতিক কৃষি উন্নয়ন তহবিলের ঋণ হিসেবে ৮৫৪ কোটি টাকা ও ডেনমার্কের উন্নয়ন সংস্থা ডানিডা অনুদান হিসেবে ১১০ কোটি টাকা দেওয়ার কথা ছিল। বাস্তবায়নের দায়িত্বে থাকবে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি)। পাঁচ বছর মেয়াদের প্রকল্পটির আওতায় ৩৩৪ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ, ৫৮টি বাজার পুনর্বাসন, ৩৪টি ঘাট নির্মাণ, ৭২টি আশ্রয়কেন্দ্র, ৪৮০টি শৌচাগার ও ৭২০টি নলকূপ স্থাপনের পরিকল্পনা ছিল। এ ছাড়া ৪০ হাজার যুবককে প্রশিক্ষণ ও ২০ হাজার যুবককে উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়।
অনুমোদিত ১৩ প্রকল্প
একনেকে অনুমোদিত প্রকল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে– কক্সবাজারে কৃষি খাদ্য ব্যবস্থা রূপান্তরের মাধ্যমে স্থিতিশীলতা বৃদ্ধির উদ্যোগ। প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয়েছে ৫৩ কোটি টাকা। গ্রামীণ মাটির রাস্তা টেকসইকরণ প্রকল্প তৃতীয়বারের মতো সংশোধন হয়েছে। এবারের সংশোধনে ব্যয় বাড়ানো হয়েছে ৭৭ কোটি টাকা। এ নিয়ে প্রকল্পের মোট ব্যয় দাঁড়াবে ৫১০ কোটি টাকা। খুলনা বিভাগের পল্লি অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পটিও তৃতীয়বারের মতো সংশোধন করা হলো। এতে মোট ব্যয় দাঁড়াবে ২৭৫ কোটি টাকা। প্রথমে প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছিল ২৬৩ কোটি টাকার কিছু বেশি।
অনুমোদিত অন্য প্রকল্পগুলো হচ্ছে– জামালপুর শহরের নগর স্থাপত্যের পুনঃসংস্কার, গাজীপুর সিটি করপোরেশনের অভ্যন্তরীণ সড়ক ও ফুটপাত উন্নয়ন, উত্তরা লেক উন্নয়ন, ক্যানবেরায় বাংলাদেশ দূতাবাস ভবন নির্মাণ, কিশোরগঞ্জ থেকে পাকুন্দিয়া-মির্জাপুর টোক সড়ক উন্নয়ন, বিএসটিআইয়ের পরীক্ষাগার সম্প্রসারণ, ঘোড়াশাল তৃতীয় ইউনিট রিপাওয়ারিং, পাবনার মানসিক হাসপাতালকে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন ইনস্টিটিউটে রূপান্তর এবং রেলওয়ের পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চলের লেভেল ক্রসিং গেট পুনর্বাসন।