সব সূত্রই নির্ভরযোগ্য নয়: বাংলাদেশ নিয়ে ‘ঘোস্ট রাইটারদের’ প্রশ্নবিদ্ধ বয়ান

মুদ্রাস্ফীতি বাড়ছে। সুদহার চড়েছে ১২ শতাংশের ওপর। অর্থনৈতিক টানাপোড়েনে থাকা বাংলাদেশিরা সামনে একটা কঠিন প্রশ্ন তুলতে পারে—কীভাবে টানাপোড়েনে থাকা একটি দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরের মেয়ে বিলাসী জীবনযাপন করছেন। অর্থনীতির এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নর কীভাবে ‘ফার্ম হাউসে’ নিশ্চিন্তে থাকেন?যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অনলাইন ম্যাগাজিন ইন্টারন্যাশনাল পলিসি ডাইজেস্টে (আইপিডি) গত ৩১ জানুয়ারি প্রকাশিত একটি লেখার শুরু হয়েছে এভাবে। যার লেখকের নাম টিম লারকিন। কিন্তু এই টিম লারকিন বাস্তবে আছেন কি না, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। তথ্যব্যবস্থায় প্রযুক্তির প্রভাব নিয়ে গবেষণাকারী প্রতিষ্ঠান ডিজিটালি রাইটের তথ্য যাচাইয়ের উদ্যোগ ডিসমিসল্যাব এক প্রতিবেদনে এ কথা উল্লেখ করেছে।

গতকাল বুধবার প্রকাশিত ডিসমিসল্যাবের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, আইপিডির ওয়েবসাইটে বাংলাদেশবিষয়ক যেসব লেখা সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে, তার মধ্যে অন্তত ১০টি নিবন্ধ এমন লেখকদের নামে প্রকাশ করা হয়েছে, যাঁদের কোনো সত্যিকার পরিচয় পাওয়া যায় না। ঘোস্ট রাইটার বা ছায়া লেখকদের নামে প্রকাশিত এসব নিবন্ধে জুলাই গণ–অভ্যুত্থান পরবর্তী সরকারের নানা সমালোচনা করা হয়েছে।যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়াভিত্তিক অনলাইন ম্যাগাজিন আইপিডি ২০১১ সালে প্রতিষ্ঠিত। আইপিডি বৈশ্বিক ঘটনা, আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও কূটনীতি বিষয়ে লেখা প্রকাশ করে আসছে।ডিসমিসল্যাব বলছে, বাংলাদেশ বিষয়ে আইপিডিতে সম্প্রতি প্রকাশিত ১০টি নিবন্ধের লেখকদের শনাক্ত করা যায় বা যোগাযোগ করা যায়—এমন কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি অনুসন্ধানে। কোনো কোনো লেখকের প্রোফাইল ছবি নেওয়া হয়েছে ‘সাটারস্টক’, ‘ফ্রিপিক’ ওয়েবসাইট থেকে।

আইপিডিতে প্রকাশিত এমন দুটি নিবন্ধ যাচাই–বাছাই ছাড়াই বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমে পুনঃপ্রকাশ করা হয়েছে উল্লেখ করে ডিসমিসল্যাব বলেছে, ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়সহ কেউ কেউ এসব লেখা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শেয়ার করেছেন।ডিসমিসল্যাবের প্রতিবেদনে বলা হয়, এই প্রচারের বিশেষ লক্ষ্য ছিলেন গভর্নর আহসান এইচ মনসুর। শেখ হাসিনা ও তাঁর সহযোগীদের পাচার করা অর্থ ফিরিয়ে আনতে যুক্তরাজ্য সরকারের সহায়তা বিষয়ে আলোচনা করতে গত মার্চে আহসান এইচ মনসুর যুক্তরাজ্য সফর করেন। এই সফরের সময়ের সঙ্গে মিল রেখে কমপক্ষে তিনটি নিবন্ধ লেখা হয় তাঁর ব্যাংক পরিচালনা নীতির সমালোচনা, তাঁর মেয়ের ‘বিলাসী জীবন’ ও তাঁকে ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণ করে।

ব্রিটিশ পত্রিকা দ্য গার্ডিয়ান জানায়, যুক্তরাজ্যের কর ও দুর্নীতি নিয়ে কাজ করা সর্বদলীয় সংসদীয় কমিটির সদস্যরা আহসান এইচ মনসুরের সঙ্গে গত মার্চে পূর্বনির্ধারিত বৈঠকের আগে কয়েকটি মেইল পান। যেখানে তাঁর মেয়ের সম্পত্তি নিয়ে প্রশ্ন তোলা আইপিডির নিবন্ধের লিংক যুক্ত ছিল। ধারণা করা হয়, এসব মেইল একজন সাংবাদিক এবং যুক্তরাজ্যের একটি জনসংযোগ প্রতিষ্ঠানের পাঠানো। গার্ডিয়ান কথিত সেই সাংবাদিকের খোঁজ পায়নি। আর জনসংযোগ প্রতিষ্ঠানটি বলেছে, তারা কার পক্ষ থেকে এই কাজ করেছে, তা প্রকাশ করবে না।আর জনসংযোগ প্রতিষ্ঠানটি বলেছে, তারা কার পক্ষ থেকে এই কাজ করেছে, তা প্রকাশ করবে না।ডিসমিসল্যাবের প্রতিবেদনে বলা হয়, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এসব ভুল তথ্য ও অপপ্রচারকে কোনো ধরনের যাচাই–বাছাই করা ছাড়া প্রকাশ করার মধ্য দিয়ে আইপিডির সম্পাদকীয় তদারকিতে বড়সড় ঘাটতির বিষয়টি অনুসন্ধানে স্পষ্ট হয়েছে। তারা কী ধরনের লেখা প্রকাশ করে, সেটা পরীক্ষা করতে ডিসমিসল্যাব কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) দিয়ে তৈরি দুটি লেখা আইপিডির কাছে পাঠায়। একটি ছিল সদ্য গঠিত রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টিকে (এনসিপি) নিয়ে ইতিবাচক লেখা, অন্যটি জুলাই গণ–অভ্যুত্থানে সংঘটিত হত্যাকাণ্ড নিয়ে জাতিসংঘের তদন্তকে প্রশ্নবিদ্ধ করে লেখা। এসব লেখার জন্য ডিসমিসল্যাব ভুয়া লেখকের প্রোফাইল বানায়। এ দুটি লেখাতেই ভুল তথ্য দেওয়া ছিল, যা ফ্যাক্টচেকে ভুল প্রমাণিত। আইপিডি জাতিসংঘের তদন্তকে প্রশ্নবিদ্ধ করে লেখাটি ছাপলেও এনসিপি নিয়ে লেখাটি ছাপেনি।

ভুতুড়ে বিশেষজ্ঞ:

ডিসমিসল্যাব বলছে, তারা আইপিডিতে প্রকাশিত ১০টি নিবন্ধের লেখকদের বিষয়ে অনুসন্ধান চালিয়েছে। এসব নিবন্ধের সঙ্গে দেওয়া লেখকের ছবি আসল কি না, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাদের উপস্থিতি আছে কি না, অনলাইনে এসব লেখকের সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায় কি না অথবা তাদের ওয়েবসাইট, যোগাযোগের নম্বর বা ই–মেইল—এসব খুঁজে পেতে অনলাইনে সেই অনুসন্ধান চালানো হয়। ১০ জন লেখকের মধ্যে ৮ জন লেখক সম্পর্কে কোনো তথ্যই পাওয়া যায়নি। ইন্টারনেটে তাদের কোনো উপস্থিতি নেই। তাদের নিবন্ধে লেখকের যে ছবি জুড়ে দেওয়া হয়েছে, সেগুলো নেওয়া হয়েছে ‘সাটারস্টক’ ও ‘ফ্রিপিক’ থেকে। তাদের সঙ্গে যোগাযোগের কোনো ধরনের মাধ্যমের খোঁজ পাওয়া যায়নি অনুসন্ধানে।লেখা প্রকাশে আইপিডির সম্পাদকীয় তদারকির বিষয়ে জানতে ডিসমিসল্যাবের পক্ষ থেকে ই–মেইলে যোগাযোগ করা হয় আইপিডির প্রধান সম্পাদক জন লাইম্যানের সঙ্গে। তিনি বলেন, লেখকদের সঙ্গে একটা আস্থার সম্পর্কের ভিত্তিতে তাঁরা লেখা ছাপেন। প্রায় তিন হাজার প্রদায়ক লেখেন তাঁদের ম্যাগাজিনে। তিনি স্বীকার করেন, হয়তো এর মধ্যে কিছু ভুয়া লেখকের লেখাও প্রকাশিত হয়ে গেছে। লাইম্যান বলেন, কিছু লেখক মাঝেমধ্যে তাদের নাম ঊহ্য রাখার অনুরোধ করলে তাঁরা সেটা করেন। কিন্তু লেখা প্রকাশের আগে লেখকদের ইতিবৃত্ত খতিয়ে দেখেন কি না, সেটা তিনি স্পষ্ট করেননি।আইডিপি যে শুধু ভুয়া লেখকদের লেখা ছাপে তা নয়, এই ম্যাগাজিনে অনেক শক্তিশালী প্রোফাইলের লেখকদের লেখাও ছাপা হয়। যেমন জুলাইয়ের গণ–অভ্যুত্থানের আগেই বাংলাদেশ নিয়ে অন্তত পাঁচটি নিবন্ধ তারা প্রকাশ করেছে, যেগুলোর লেখকদের সত্যিকারের পরিচয় ছিল। এসব নিবন্ধে বাংলাদেশের ইতিহাস, আঞ্চলিক রাজনীতি ও অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা করা হয়েছিল।তবে তাদের সম্পাদকীয় তদারকির দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে যে কেউ অপতথ্য ও ভুল তথ্যসমৃদ্ধ লেখা প্রকাশ করে নিতে পারে।জানতে চাইলে ডিজিটালি রাইট–এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিরাজ আহমেদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘সব বিদেশি ওয়েবসাইটই বিশ্বাসযোগ্য নয়। এই যুগে কোথাও কোনো লেখা পেলেই এবং সেটি আপনার ধারণা বা বিশ্বাসের সঙ্গে মিলে গেলেই তা পুনঃপ্রকাশ করে ফেলা ঝুঁকিপূর্ণ।’ তাঁর মতে, প্রকাশের আগে লেখকের যোগ‍্যতা, তথ‍্যের সত‍্যতা এবং সেই ওয়েবসাইটের বিশ্বাসযোগ‍্যতা যাচাই করতে হয়। নয়তো সংবাদমাধ‍্যমও ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় একটি মিথ‍্যা প্রচারণার অংশ হয়ে যায়। এভাবে অপপ্রচারও অনলাইনে স্থায়ী হয়ে যায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *