মার্কিন কবি জয়েস কিমলার (১৮৮৬-১৯১৮) ট্রিজ নামে একটি কবিতা লিখেছিলেন। ১৯১৩ সালের আগস্ট সংখ্যায় পোয়েট্রি সাময়িকপত্রে প্রকাশিত হয়েছিল। কবিতার শেষ দুটি লাইনের অর্থ– ‘কবিতা আমার মতো মূর্খেরাই নির্মাণ করে, তবে কি না ঈশ্বরই কেবল বৃক্ষ সৃষ্টিতে সক্ষম।’
গাছের কাছে গিয়ে বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকি! কী অসাধারণ তার সৌন্দর্য, সাম্য ও সৌম্য চেহারা, যেন সে কোনো বনের তপস্বী!
পূর্বাচল উপশহরে সূর্যটা তখন পূর্বদিক থেকে পশ্চিমে ঢলে পড়েছে। হেমন্ত বিকেলের কোমল রোদটুকু মেখে শালবনের গাছগুলো সেই রৌদ্ররস পান করছে। ছোট গাছগুলোরও কী শোভা! বিশেষ করে একটা অনুচ্চ ঝোপের মধ্যে থাকা জটা শালপানি গাছের পত্রপল্লবের শোভা থেকে চোখ ফেরানো যায় না। রবীন্দ্রনাথের কথায় যেন পাতাগুলোর মুক্তবেণী মাঠের ওপর লোটে। রুই মাছের আঁইশের মতো গোল গোল সবুজ পাতাগুলো একটার পিঠে আরেকটা চমৎকার করে গেঁথে আছে লম্বা পর্ণ ছড়ায়। সন্ন্যাসীদের জটার মতো ঝোলা পল্লবিত শাখা-প্রশাখার জন্যই সম্ভবত এ গাছের বাংলা নাম হয়েছে জটা শালপানি। ইংরেজি নাম Angel’s locks এবং Pretty dragon’s tongue. গাছের ডাল-পাতা আসলেই তো দেখতে ড্রাগনের লকলকে জিহ্বার মতো।
জটা শালপানি গাছের ডালপালা আর পাতা এমনভাবে জন্মে, যেন একটি পাতা আর একটি পাতাকে সূর্যালোক পাওয়াতে আড়াল না করে। বাদামি রঙের কাষ্ঠল সরু ডালে গেঁথে আছে আগার পাতাগুলো। ডালের গোড়ার পাতার সঙ্গে আগার পাতার কোনো মিলই নেই। আগার পাতাগুলো ছোট ও গোলাকার থেকে ডিম্বাকার, কিন্তু পাতাগুলোর বয়স বাড়লেই সেগুলোর চেহারা বদলে যায়, বড় হয়, তখন পাতারা হয়ে পড়ে আয়ত-বল্লমাকৃতির, অগ্রভাগ সুচালো ও মাঝারি।
জটা শালপানি একটি বহুবর্ষী সরু কাণ্ডবিশিষ্ট দোলায়মান শাখা-প্রশাখার বহু শাখায়িত গুল্ম প্রকৃতির গাছ। এ গাছ ৫০ থেকে ২৫০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। বাংলাদেশে আদিবাসী ও বনবাসীরা এর বাকল থেকে ঔষধ বানায়। বাকলের ক্বাথ ডায়রিয়ার নিরাময়ক। শিকড় থেকে জ্বর সারানোর ঔষধ বানানো হয়।
জটা শালপানির উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম Phyllodium pulchellum ও গোত্র ফ্যাবেসি। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ গবেষক আব্দুর রহিম জানান, গাছটি এশিয়া মহাদেশেরই। এ দেশে প্রধানত অরণ্য বা গভীর বনে এ গাছ দেখা যায়। বিশেষ করে শালবনের প্রান্তসীমায় এরা বেশি জন্মে। তবে আলংকারিক শোভার কারণে কেউ কেউ এ গাছ বাগানে লাগিয়ে বৈচিত্র্য সৃষ্টি করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ প্রাঙ্গণে একটি জটা শালপানি গাছ আছে। কোনো কোনো নার্সারিতেও এর চারা পাওয়া যায়। তবে প্রাকৃতিক পরিবেশে জন্মানো গাছের রূপ হয় আলাদা। প্রাকৃতিক আবাসস্থলে জন্মানো গাছ মাটিতে থাকা এক ধরনের ব্যাকটেরিয়ার সঙ্গে সংঘবদ্ধতা বা মিথোজীবিতা করে, তাদের সাহায্যে বাতাস থেকে নাইট্রোজেন সংগ্রহ করে মাটিতে মজুত করে। এ জন্য এ গাছ যেখানে জন্মায়, সেখানকার মাটির উর্বরতা বাড়ে।
বন উজাড়ের ফলে ধীরে ধীরে এ গাছ কমে যাচ্ছে। আশার কথা হলো, সরকার পূর্বাচল উপশহরের শালবনগুলো সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছে। এতে হয়তো অনেক গাছপালারা রক্ষা পাবে, টিকে থাকবে জটা শালপানিও।