বাংলার সার্কাস এখন বিলুপ্তির পথে

এক সময় গ্রামীণ মেলার প্রাণ ছিল সার্কাস। রঙিন তাঁবু, করতালির শব্দ, বাঘের গর্জন আর দর্শকের বিস্ময়ে ভরা মুখ—সব মিলিয়ে সার্কাস ছিল এক জাদুর নাম।

কিন্তু এখন সেই জাদু হারিয়ে গেছে। মাঠে নেই তাঁবু, নেই আলো, নেই হাসির ঢেউ। বাংলা লোকসংস্কৃতির অন্যতম অনুষঙ্গ সার্কাস আজ বিলুপ্তির পথে।

এক সময় দেশের শহর থেকে মফস্বল—সব জায়গাতেই সার্কাস মানেই ছিল উৎসব। এখন অনুমোদন জটিলতা, আর্থিক সংকট ও প্রাণী ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞার কারণে একে একে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে দলগুলো।

সার্কাস শুধু খেলা নয়—এটি একদল মানুষের জীবিকা। একটি সার্কাস দলে থাকতেন শতাধিক মানুষ—মালিক, শিল্পী, সরঞ্জাম বহনকারী, তাঁবু স্থাপনকারী, এমনকি প্রাণী পরিচর্যাকারীও। তাঁদের সবার জীবিকা নির্ভর করত মেলার মাঠে জমে ওঠা ভিড়ের ওপর। এখন সেই মেলাই নেই। ফলে অনেকে দল ছেড়ে চলে গেছেন অন্য পেশায়।

মফস্বলের জেলাগুলোতে এখন বড় মেলার আয়োজন খুবই কম। অথচ সার্কাসের জন্য প্রয়োজন প্রশস্ত মাঠ ও অন্তত ১৫ দিনের প্রদর্শনী।

সাংস্কৃতিক কর্মী রুদ্র কমল বলেন, “ফরিদপুরে কবি জসীমউদ্দীনের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে যে লোকমেলা হয়, সেখানেই এখন নিয়মিত সার্কাস দেখা যায়। দেশের অন্য কোথাও নেই।” তিনি আক্ষেপ করে বলেন, “শিশুরা এখন সার্কাস কী, সেটাই জানে না।”

এক সময় বাংলার মাটিতে রাজত্ব করত নামি সার্কাস দলগুলো—রয়েল বেঙ্গল সার্কাস, সোনার বাংলা সার্কাস, সেভেন স্টার সার্কাস, রওশন সার্কাস ও লায়ন সার্কাস।

বরিশালের লক্ষণ দাসের নেতৃত্বে ‘রয়েল বেঙ্গল সার্কাস’ ছিল সবচেয়ে জনপ্রিয়। মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হওয়ার পর তাঁর ছেলেরা ‘সোনার বাংলা সার্কাস’ চালু করেন। এক সময় এই দলগুলো ঘুরে বেড়াত সারা দেশে। আজ তারা ইতিহাসের পাতায় হারিয়ে গেছে।

দড়ির ওপরে জীবন বাজি রেখে হাঁটা শিল্পী, আগুনের বল হাতে দাঁড়ানো নারী কিংবা বাঘের খাঁচায় কসরত দেখানো মানুষ—তাঁদের হাসি ছিল অন্যের আনন্দের জন্য। আজ সেই শিল্পীরা জীবনের কষ্টে হারিয়ে যাচ্ছেন।

সার্কাস শুধু বিনোদন নয়—এ এক মানবিক ইতিহাস। যাঁরা ভয়, ক্ষুধা আর অনিশ্চয়তার মাঝেও মানুষকে আনন্দ দিতে চেয়েছেন, তাঁরাই এই শিল্পের প্রকৃত নায়ক। তাঁদের জীবনের আলো হয়তো ম্লান, কিন্তু তাঁদের ত্যাগ আর সাহসের গল্প চিরকাল বেঁচে থাকবে মানুষের মনে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *