জুলাই মাসের অভ্যুত্থানের সময় আন্দোলনকে ত্বরান্বিত করতে এবং নেতৃত্ব দিতে যারা সামনে থেকে সমন্বয় করেছেন, তাদের মধ্যে মাহফুজ আলম ছিলেন অন্যতম। আন্দোলন চলাকালে আওয়ামী সরকারের ব্যাপক হত্যাকাণ্ড ও গণগ্রেপ্তারের সত্ত্বেও তিনি আন্দোলনটি সচল রাখার কাজে যুক্ত ছিলেন। ২৪ জুলাই অভ্যুত্থানের পর সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের ‘ক্লিনটন গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ লিডার্স স্টেজ’ অনুষ্ঠানে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস তাকে এই অভ্যুত্থানে নেপথ্য নায়ক হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেন। অভ্যুত্থানের পর অধ্যাপক ইউনূসের বিশেষ সহকারী হিসেবে মাহফুজ আলম নিয়োগ পান এবং ফেব্রুয়ারিতে তিনি তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নেন।
বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থাকে (বাসস) দেওয়া এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে মাহফুজ আলম জুলাই অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপট, ছাত্র-জনতার আকাঙ্ক্ষা এবং আধুনিক রাষ্ট্র গঠন নিয়ে আলোচনা করেছেন।
প্রশ্ন: আপনি মনে করেন, কোন কোন ঘটনা জুলাই অভ্যুত্থানকে অনিবার্য করে তুলেছিল?
মাহফুজ আলম: আওয়ামী লীগ শাপলা-শাহবাগের বিভাজন তৈরি করে রাষ্ট্রকে ইসলামিস্ট বা সেক্যুলার হিসেবে ভাগ করার চেষ্টা করেছিল, যা ২০১৪ সালের নির্বাচনের সাথে সম্পর্কিত। ২০১৫ সালের বিএনপির আন্দোলন এবং আওয়ামী সরকারের দমন-পীড়নের ফলে বিরোধী দল প্রায় অস্তিত্বহীন হয়ে পড়েছিল। পরবর্তীতে, ২০১৮ সালের নির্বাচন পরবর্তী সময়েও ছাত্রদের মধ্যে একটি ডেমোক্রেটিক প্রেসার গ্রুপ গড়ে ওঠে। ২০১৮ সালের আন্দোলনে অংশগ্রহণ করা কলেজের ছাত্ররা ২৪ জুলাইয়ের অভ্যুত্থানে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া ছিলেন, এবং তাদের কাছে সরকারের দুঃশাসনের চিত্র পরিষ্কার ছিল, ফলে রাজনৈতিক সচেতনতার সঙ্গে আন্দোলনে অংশ নেওয়া তাদের জন্য সহজ ছিল। সীমান্ত হত্যা বিরোধী আন্দোলন এবং বিশ্বজিৎ দাস হত্যাকাণ্ডও এই অভ্যুত্থানে গুরুত্ব পেয়েছিল।
প্রশ্ন: ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের বাইরে স্বৈরাচার পতনের অন্য কোন উপায় ছিল?
মাহফুজ আলম: আওয়ামী লীগ ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়াটি সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে ফেলেছিল, তাই নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন কিংবা রাজনীতি দিয়ে তাদের পতন সম্ভব ছিল না। সেনাবাহিনীর ক্ষমতা দখল করার সম্ভাবনাও আর ছিল না। জনগণের মধ্যে একটি অপেক্ষা ছিল সত্যিকার নেতৃত্বের জন্য, যা শেষ পর্যন্ত ছাত্রদের দ্বারা সামনে আসে, এবং তা শ্রমিক-জনতার সমর্থন লাভ করে। এ কারণে, শেখ হাসিনার পতনের জন্য গণঅভ্যুত্থান অনিবার্য ছিল।
প্রশ্ন: জুলাই অভ্যুত্থানে একদমই ভিন্ন আদর্শের মানুষরা কীভাবে এক হয়ে গিয়েছিল?
মাহফুজ আলম: আন্দোলনেও কিছু কম্প্রোমাইজিং এলিমেন্ট ছিল, কিন্তু আমরা দীর্ঘদিন ক্যাম্পাসে এক্টিভিজম করার ফলে সে বিষয়গুলো জানতাম এবং সেগুলোর মোকাবিলা করে ছিলাম। আমাদের লক্ষ্য ছিল এমন একটি ঐক্য গড়া, যেখানে রাজনৈতিক ভিন্নতা থাকা সত্ত্বেও সবাই একযোগে কাজ করতে পারে।
প্রশ্ন: সাংস্কৃতিক বোঝাপড়া আন্দোলনে কীভাবে প্রভাব ফেলেছিল?
মাহফুজ আলম: সাংস্কৃতিক বিভাজন অনেক শক্তিশালী এবং এটি আন্দোলনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। আমাদের একটি মধ্যপন্থী গ্রুপ প্রয়োজন ছিল, যারা না ইসলামিস্ট, না সেক্যুলার। মাদ্রাসা ছাত্র, কলেজ-ভার্সিটি ছাত্র এবং শহুরে-গ্রামাঞ্চলের মানুষদের মধ্যে এই ঐক্য গড়ে উঠেছিল। ফলে, সাংস্কৃতিক বোঝাপড়া ও বৈচিত্র্যময় মতাদর্শের মধ্য দিয়ে একতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
প্রশ্ন: জুলাই গণহত্যার সাথে জড়িতদের বিচারের জন্য ‘ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন’ পদ্ধতি কার্যকরী হবে কিনা?
মাহফুজ আলম: সত্যের অনুসন্ধান ও স্বীকারোক্তির মাধ্যমে বিচার হওয়া উচিত। বিচার ব্যবস্থায় অপরাধীদের শাস্তি দেয়া যেতে পারে, কিন্তু পাপীকে শুধুমাত্র শাস্তি দিয়ে মুক্ত করা সম্ভব নয়। তাকে স্বীকারোক্তি ও ক্ষমা চাওয়ার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সামনে আসতে হবে।
প্রশ্ন: আন্দোলনের এক দফা দাবিতে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের আকাঙ্ক্ষা ছিল। আমরা কি এখন সেই দিকে এগোচ্ছি?
মাহফুজ আলম: নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত সম্ভব তখনই, যখন রাজনৈতিক সংস্কৃতির সংস্কার হবে। যদি আমরা বিরোধী দল বা পক্ষকে সম্মান না করি, তবে রাজনৈতিক সংস্কার হবে না। রাজনৈতিক সংস্কৃতির উন্নতির জন্য, রাজনৈতিক দলগুলোকে নতুন এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে।