ঢাকার বাকি প্রত্নসম্পদগুলোর ভাগ্যে কী আছে?

বাড়ির ভেতরে যেতেই চোখে পড়ল, লাল অক্ষরে লেখা ‘বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কর্তৃক সংরক্ষিত এলাকা, সর্বসাধারণের প্রবেশ নিষেধ’। এলাকার বাসিন্দারাও বলছেন, এর ফলে দীর্ঘদিন ধরেই ভেতরে প্রবেশের ক্ষেত্রে বাধা পাচ্ছেন তারা।

বাড়িতে থাকা রিতা নিজেকে সেনা কর্মকর্তার স্ত্রী হিসেবে পরিচয় দিয়ে বলেন, “এটা কোয়ার্টার, সেনাবাহিনীর আন্ডারে আছে। জাহাজে যারা থাকেন তাদের পরিবার এখানে থাকে। বাসা নেওয়ার জন্য অফিসে আবেদন করা লাগে তখন দেয়। এখানে থাকলে বাসা ভাড়া লাগছে না, বিদ্যুৎ, পানি সবকিছুর সুবিধা আছে। বাইরের কেউ থাকে না।”

বাড়ি দুটোর বিষয়ে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের ঢাকা বিভাগের আঞ্চলিক পরিচালক আফরোজা খান মিতা বলেন, সরকারের দখলে নিতে অতীতে কিছু উদ্যোগ নেওয়া হলেও গত দুই আড়াই বছরে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।

“তাদেরকে সরিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে কী কী পদক্ষেপ নিতে হবে, সেটার জন্য টাকা লাগবে। যদি এটাকে আমাদের কিনতে হয়, যারা এখন আছেন তাদের ব্যবসা রুটিরুজি তো এখানে…হুট করে করা যায় না। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার বিষয়। কী কী করা যায় আমাদের ভাবনার মধ্যে আছে।”

পুরান ঢাকার আরেকটি ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা ‘বিউটি বোর্ডিংয়ের’ পাশের জমিদার বাড়িটি ঢেকে রেখেছে বটগাছের শিকড়, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কিছু অংশের দেয়াল। বাড়িটির বাইরের অংশে দোকান, সেলুন করা হয়েছে আর ভেতরের নিচ তলায় থাকছে একটি পরিবার এবং উপরের তলার এক পাশে পুলিশ ফাঁড়ি, আরেক পাশে পুলিশ সদস্যরা থাকেন। বাড়ির দেয়ালে ‘বিউটি বোর্ডিং’, ‘কমিউনিটি পুলিশ অফিস’ সাইনবোর্ড।

বাড়ির নিচতলায় কয়েকজন নারীকে পাওয়া গেল। এর মধ্যে এক প্রৌঢ় নারী এখানে থাকার বিষয়টি স্বীকার করলেও কীভাবে থাকছেন তার উত্তর দেননি।

পুলিশ ফাঁড়ির কনস্টেবল কাওছার বলেন, “নিচে পাবলিক নিজেরা দখল করে থাকছে। এখানে পুলিশ ফাঁড়ি অনেক দিন ধরেই, আমরা নতুন তাই সময় বলতে পারছি না।”

নাম প্রকাশ না করে এলাকার এক বাসিন্দা বলেন, “মন্দিরে পূজা করতে আসত। পরে এরা দখলে নিছে। ২০/২৫ বছর ধরে থাকে।”

রতন সেলুনের রতন বলেন, নিচতলার দোকানদাররা মাসে মাসে বিউটি বোর্ডিংকে ভাড়া দেয়; তিনিও দেড়/দুই হাজার টাকা ভাড়া দেন।

“বাড়ির মালিক কে জানি না। ভেতরে যারা থাকে এরা মাগনা থাকে।”

দোকানগুলো ভাড়া দিয়েছেন কি না, জানতে চাইলে বিউটি বোর্ডিংয়ের তত্ত্বাবধানে থাকা সমর সাহা বলেন, “বিল্ডিংয়ের বাইরে হলে- ওগুলা তো আমাদের না। আমাদের কমপ্লেক্সের বাইরে আমাদের কিছু নাই, অন্যের।”

ফরাশগঞ্জের ‘মঙ্গলালয়’ বাড়িটি ব্যবহৃত হচ্ছে মসলার আড়ৎ হিসেবে, বাড়ির ভেতরে থাকছেন আড়তের শ্রমিকরা। বাড়ির বাইরে জাতীয় পার্টির নেতা সাইফুদ্দিন মিলনের পোস্টার সাঁটানো।

মসলার আড়ৎ রিফাত বাণিজ্যালয়ের সাইদুর রহমানের দাবি, দোকান আর গুদামের জন্য মাসে তিনি ৫৫ হাজার টাকা করে ভাড়া দেন সাইফুদ্দিন মিলনকে।

সাইফুদ্দিন মিলন নিজেকে বাড়িটির মালিক হিসেবে দাবি করেছেন।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ২০১০/১১ সালে ‘এক হিন্দু বাবুর’ কাছ থেকে তিনি বাড়িটি কিনেছেন; যিনি পরে ভারতে চলে গেছেন। বাড়িটি সংরক্ষণ না করে বড় ভবন তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে তার, দুই তিনবার বাড়িটির আস্তরও করা হয়েছে।

“এটা হিন্দু প্রপার্টি, নর্মাল হিন্দুগো। এটা তো কোনো জমিদার-টমিদার না। যখন কিনছি না, তখন এইডারে ভাংতে পারতাম। তখন সমস্যা হইছে ড্যাবের আইনের মধ্যে আমার বাড়ির অর্ধেক দিক চইল্যা গেছিল। তখন আমারে রাজউক থেকে বলছিল, ‘আপনি ভাইঙেন না ড্যাবের আইনটা সংশোধন হচ্ছে। তাইলে আপনি পুরো বাড়িতে কাজ করতে পারবেন’। এজন্য বাড়িটা ভাঙিনি। এটা তো প্রত্নতত্ত্বে যাওয়ার মত বাড়ি না।”

হৃষিকেশ বাবুর বাড়ির বাইরের দেয়ালে সাইনবোর্ডে লেখা ‘এই বাড়ির মালিক আলহাজ্ব গোলাম মাওলা মল্লিক’। বাড়ির ভেতরের অংশের দেয়ালে নতুন রঙ করা হয়েছে, তবে ফটক বন্ধ থাকায় বাড়ির ভেতরে যাওয়া যায়নি।

এলাকার এক বাসিন্দা প্রকাশ না করে বলেন, পরিবারটি ৪০/৫০ বছর ধরে এখানে থাকছে। তাদের আড়তের কর্মচারীরাও এখানে থাকেন।

বাড়ির উত্তরাধিকারী সানি মল্লিক বলেন, “এটা আমাদের বাড়ি। এটা আমার দাদা কিনছিল ঋষিকেশ বাবুর কাছ থেকে।”

গত জুনে কোরবানির ঈদের ছুটির মধ্যে পুরান ঢাকার নারিন্দায় ‘মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন স্মৃতি ভবন’ ভাঙার চেষ্টা করা হয়। আর পুরোপুরি ভেঙে ফেরা হয় শতবর্ষী নারিন্দা স্যুয়ারেজ পাম্পিং স্টেশনের ঐতিহাসিক একটি ভবন, যেটি ঢাকা ওয়াসার প্রথম স্যুয়ারেজ পাম্পিং স্টেশন।

শরৎগুপ্ত রোডের নাসিরউদ্দীন স্মৃতি ভবনটি ‘সওগাত’ পত্রিকার সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন, ‘বেগম’ পত্রিকার সম্পাদক নূরজাহান বেগম, সাহিত্যিক রোকনুজ্জামান খান দাদা ভাইয়ের স্মৃতিবিজড়িত।

ঈদের ছুটিতে ভবনটি ভাঙার কাজ শুরু হয়। বিষয়টি জানতে পেয়ে ১৪ জুন গেণ্ডারিয়া থানায় জিডি করে আরবান স্টাডি গ্রুপ। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের তরফেও জিডি করা হয়। এরপর বাড়িটি ভাঙার কাজ ঠেকিয়ে রাখে পুলিশ।

এই ভাঙচুরের ঘটনাগুলো ঘটেছে কখনও বেসরকারি ভবনে, কখনও সরকারি মালিকানাধীন বা ব্যবস্থাপনাধীন ভবনে। এমনকি আদালতের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করেও স্থাপনা ভাঙচুর করা হয়েছে বলে আরবান স্টাডি গ্রুপের এক বিবৃতিতে দাবি করা হয়।

আইন কী বলে?

পুরাকীর্তি আইন বলছে, কোনো জমিতে প্রাচীনত্ব রয়েছে- সরকারের এমন যুক্তিসঙ্গত কারণ থাকলে সেটি বা এর কোনো অংশ অধিগ্রহণ করতে পারে। সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপন দ্বারা, যে কোনো প্রাচীন জিনিসকে একটি সুরক্ষিত প্রাচীন জিনিসপত্র হিসেবে ঘোষণা করতে পারে।

প্রাচীন জিনিস ধ্বংস, অপসারণ, পরিবর্তন বা বিকৃত করা অথবা প্রাচীনত্বের স্থানে বা তার কাছাকাছি নির্মাণ করার ক্ষেত্রে মালিকের অধিকারের ওপর বিধিনিষেধ থাকবে। জনসাধারণের প্রবেশাধিকারের সুযোগ-সুবিধা; স্বত্ব বিনিময়ের ফলে মালিক বা দখলদার বা অন্য কোনো ব্যক্তির ক্ষতির জন্য প্রয়োজনীয় ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে।

প্রাচীন জিনিসপত্রের মালিকের খোঁজ পাওয়া না গেলে, প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর সরকারের অনুমোদন নিয়ে এবং যতক্ষণ মালিকের খোঁজ না পাওয়া যায়, ততক্ষণ সংরক্ষণ ও সুরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারবে।

কোনো পুরাকীর্তি ধ্বংস, ক্ষয়প্রাপ্ত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে সরকারের এমন আশঙ্কা থাকলে উপদেষ্টা কমিটির সঙ্গে পরামর্শের পর জনসাধারণের উদ্দেশ্যে এই ধরনের পুরাকীর্তি বা এর কোনো অংশ অধিগ্রহণ করতে পারে।

যে প্রাচীন জিনিসপত্রের কোনো অধিকার সরকার অর্জন করেছে; সেগুলো ধ্বংস, ভাঙা, ক্ষতি, পরিবর্তন, বিকৃত অথবা লেখা বা খোদাই করা বা স্বাক্ষর করা যাবে না।

কেউ এ বিধান লঙ্ঘন করলে এক বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড অথবা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবে।

জাতীয় বিল্ডিং কোড ২০২০-এ বলা হয়েছে, ঐতিহাসিক বা স্থাপত্যিকভাবে মূল্যবান যেসব ভবন প্রত্নতাত্ত্বিক তালিকাভুক্ত সেগুলো সংরক্ষণ, পুনরুদ্ধারের জন্য প্রয়োজনীয় মেরামত, পরিবর্তন এবং সংযোজন করা যেতে পারে, তবে তা প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ অনুমোদিত হতে হবে। মেরামতের প্রয়োজন হলে, সেগুলোর মূল বৈশিষ্ট্য অক্ষুণ্ণ রাখতে হবে।

রাজউকের বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনায় (ড্যাপ) পুরান ঢাকার একটা বড় অংশকে ঐতিহ্যবাহী এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

সেখানে বলা হয়েছে, ‘রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের মহাপরিকল্পনাভুক্ত এলাকার ঐতিহাসিক, নান্দনিক, বৈজ্ঞানিক, সামাজিক / ধর্মীয় গুরুত্ব বিবেচনায় ৭৪টি স্থাপনা/ভবন/এলাকাকে ঐতিহ্যবাহী বিশেষ ভবন/স্থাপনা/এলাকা হিসেবে সংরক্ষণের জন্য তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। নগর উন্নয়ন কমিটির অনুমোদন ছাড়া এগুলোর আংশিক বা সম্পূর্ণ অপসারণ/ পুনঃনির্মাণ/ পরিবর্তন/ পরিবর্ধন/ পরিমার্জন/সংযোজনের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। হেরিটেজ সাইটের সীমানাপ্রাচীর থেকে ২৫০ মিটার ব্যাসার্ধ পর্যন্ত সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে বিবেচনা করা হবে।’

সংরক্ষিত এলাকায় কোনো স্থাপনা নির্মাণ করতে চাইলে তাকে পরিকল্পনায় নির্দেশিত শর্ত পূরণ এবং বিশেষ প্রকল্প কমিটির অনুমোদন সাপেক্ষে নির্মাণ অনুমতি নিতে হবে।

• তালিকাভুক্ত ইমারত/স্থাপনার সীমানা প্রাচীর থেকে ২০ মিটার পর্যন্ত সম্পূর্ণ খালি রাখতে হবে। এ দূরত্বের মধ্যে কোনো নির্মাণ/উন্নয়ন করা যাবে না। পরবর্তী ২৫ মিটার দূরত্ব পর্যন্ত ইমারতের উচ্চতা সর্বোচ্চ ১০ মিটার পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকতে পারবে। এর পরবর্তী অংশে (২৫০ মিটারের অবশিষ্ট এলাকা) ইমারতের উচ্চতা সর্বোচ্চ ১৫ মিটার পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকতে পারবে।

• সংরক্ষিত এলাকায় ইতোমধ্যে অবৈধ/অনুমোদনবিহীন/অনুমোদনের ব্যত্যয় করে নির্মিত কোনো স্থাপনা/ভবন থাকলে যথাযথ কর্তৃপক্ষ ইমারত নির্মাণ আইন এবং সংশ্লিষ্ট আইন ও বিধি মেনে সেগুলো উচ্ছেদসহ প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা নেবে।

সেভ দ্য হেরিটেজের সাজ্জাদ বলেন, “ঐতিহ্যগুলো সংরক্ষণ না করে ধ্বংসের পথে ঠেলে দিলে শেকড় ছাড়া প্রজন্ম গড়ে উঠবে।”

তিনি বলছেন, “যারা থাকছে, তারা ভেঙে ফেলতেছে ভবনের অনেক কিছু। ইচ্ছাকৃতভাবে যদি দেখানো যায় ধ্বংস হয়ে গেছে বা যাচ্ছে, তাহলে ভেঙে নতুন ভবন তৈরি করতে পারবে। এই কাগজপত্রগুলো কীভাবে আসছে? এটা কতটুকু অথেনটিক?”

সরকার যদি আর্থিক ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা না করে- তাহলে প্রাচীন স্থাপনা রক্ষা করা সম্ভব হবে না বলে মনে করেন স্থাপত্য সংরক্ষণ বিশেষজ্ঞ আবু সাঈদ এম আহমেদ।

তিনি বলেন, “অনেক স্থাপনা তো আছে ব্যক্তি মালিকানাধীন। এখন বাজারের চাহিদা অনুযায়ী অনেকে ভেঙে ফেলছেন। যেসব জায়গায় প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা আছে, সেখানে অন্য স্থাপনা করা যাবে না বলে আইনও আছে। তাই কেউ কেউ রাতের আঁধারে ভেঙে ফেলছেন।

“শুধু আইন থাকলেই তো চলবে না। সেসব স্থাপনা ব্যক্তি মালিকানাধীন সম্পত্তি, তারা তো সেখানে নতুন স্থাপনা করবেনই। এখন সরকারকে প্রণোদনা দিতে হবে এবং অবৈধ দখলদার উচ্ছেদের ব্যাপারে কঠোর হতে হবে।”

আরবান স্টাডি গ্রুপের তৈমুর বলেন, প্যারিদাস রোডে কেবল ৩/৪টা পুরনো ভবন রয়েছে, হেমেন্দ্র দাস রোডের একটা অংশ খালি করে ফেলা হয়েছে।

“আস্তে আস্তে এমন সময় আসবে, যখন আর পুরনো এলাকাগুলো খুঁজে পাওয়া যাবে না। উঁচু উঁচু বিল্ডিংগুলো যখন করে ফেলছে…প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ যে কী করে- তারাই জানে। লোকাল পলিটিক্স, বিজনেস জড়িত, জমির মালিকদের স্বার্থ রয়েছে। ঐতিহ্য রক্ষার কোনো উদ্দেশ্য কারোর নাই।”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *