‘জীবনের শ্রেষ্ঠ সিদ্ধান্তটাই নিয়েছে মাহেরীন’

মাইলস্টোনে বিমান বিধ্বস্ত

স্ত্রী মাহেরীন চৌধুরীর আত্মত্যাগের কথা বলতে গিয়ে একপর্যায়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন স্বামী মনসুর হেলাল। বুধবার বিকেলে নীলফামারীর জলঢাকা উপজেলার বগুলাগাড়ি এলাকার বাড়িতে |

‘তখন রাত আটটা কি সোয়া আটটা হবে। বার্ন ইউনিটে মাহেরীনের সঙ্গে আমার শেষ কথা হয়। বললাম, তোমার বাচ্চা দুইটার দিকে তাকিয়ে যদি একটু স্বার্থপর হতা। ও বলল, “এগুলো তো আমার বাচ্চা, সব বাচ্চাই তো আমার বাচ্চা।” এই যে তাঁর মানসিকতা। সে একটু স্বার্থপর হইলে আমাদের সন্তানদের এই অবস্থা হয় না। তার চিন্তা হয়তো ওপরের লেবেলের ছিল। তার যে শরীরের ভাষা, তাতে তার জীবনের শ্রেষ্ঠ সিদ্ধান্তটাই সে নিয়েছে।’

স্ত্রী মাহেরীন চৌধুরীর আত্মত্যাগের কথা এভাবে বর্ণনা করলেন তাঁর স্বামী মনসুর হেলাল।

মাহেরীন চৌধুরী উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষক ছিলেন। গত সোমবার যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় শিক্ষার্থীদের বাঁচাতে গিয়ে তিনি মারা যান।

মাহেরীনের বাবার বাড়ি নীলফামারীর জলঢাকার পৌর এলাকার বগুলাগাড়ি চৌধুরীপাড়ায়। তাঁর বাবা প্রয়াত মহিতুর রহমান চৌধুরী বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের আপন খালাতো ভাই।

মাহেরীনের বাবার বাড়ি নীলফামারীর জলঢাকার পৌর এলাকার বগুলাগাড়ি চৌধুরীপাড়ায়। তাঁর বাবা প্রয়াত মহিতুর রহমান চৌধুরী বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের আপন খালাতো ভাই। চার ভাইবোনের সবার বড় ছিলেন মাহেরীন চৌধুরী। গত মঙ্গলবার বিকেলে বগুলাগাড়ি স্কুল অ্যান্ড কলেজ মাঠে জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থান ‘আপন ঠিকানায়’ তাঁকে দাফন করা হয়।

উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে ক্লাস চলাকালে একটি ভবনে প্রশিক্ষণ বিমান আছড়ে পড়ে। মুহূর্তেই আগুন ধরে যায় ভবনে। তখন চারপাশে ধোঁয়া আর আতঙ্ক। মাহেরীন চৌধুরী তখন শিশু শিক্ষার্থীদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিতে ব্যস্ত ছিলেন। একপর্যায়ে নিজে অগ্নিদগ্ধ হন। জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে রাত ৯টা ৪৫ মিনিটে লাইফ সাপোর্টে থাকা অবস্থায় তিনি মারা যান।

আকস্মিক দুর্ঘটনায় স্বজনেরা স্তব্ধ

বুধবার দুপুরে চৌধুরীপাড়ায় গিয়ে দেখা গেল, সুনসান নীরবতা। বাড়িতে ছোট বোন মেহেতাজ চৌধুরী, ছোট ভাই মুনাফ মজিব চৌধুরী ও অন্য কয়েকজন স্বজন আছেন। পরিবারের এমন আকস্মিক দুর্ঘটনায় সবাই স্তব্ধ। মাহেরীনের স্বামী মনসুর হেলাল গেছেন স্থানীয় বাজারে। মুনাফ চৌধুরী জানালেন, বৃহস্পতিবার দুপুরে তাঁর বোনের জন্য বাড়িতে দোয়া অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। সে জন্য কিছু কেনাকাটা করতে তাঁর ভগ্নিপতি বাজারে গেছেন।

সব সময় তার চিন্তা ছিল, যত দিন বেঁচে থাকি সৎ কর্ম করে দেশের মানুষের যদি একটু উপকার হয়, সে ধরনের কাজে যুক্ত থাকব। এই দৃষ্টিভঙ্গি তার মধ্যে সব সময় কাজ করত।

মনসুর হেলাল, মাহেরীন চৌধুরীর স্বামী

মাহেরীন চৌধুরীর বাড়িতে থাকতে বেলা সাড়ে তিনটার দিকে শোকাহত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানাতে আসেন বগুলাগাড়ি স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষকেরা। এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি ছিলেন মাহেরীন চৌধুরী। ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মহুবার রহমান বলেন, দুর্ঘটনার এক ঘণ্টা আগেও মাহেরীন চৌধুরীর সঙ্গে তাঁর ই-মেইল আদান-প্রদান হয়। এলাকার মানুষের প্রতি তাঁর মায়া–মহব্বত ছিল। তিনি নিজের জীবনের কথা চিন্তা না করে প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের বাঁচানোর জন্য যে আত্মত্যাগ করেছেন, এটা বিশ্ববাসীর কাছে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ও অনুসরণীয় হয়ে থাকবে।

বিকেলে বাজার থেকে বাড়িতে ফিরলে কথা হয় মনসুর হেলালের সঙ্গে। জানালেন, তাঁরা দুজনই ছিলেন ঢাকার শাহীন স্কুলের শিক্ষার্থী। ১৯৯২ সালে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় তাঁদের মধ্যে বন্ধুত্ব হয়। এরপর ২০০৮ সালে তাঁরা বিয়ে করেন।

মনসুর হেলাল বলেন, ‘আমার সহধর্মিণী মাহেরীন চৌধুরীকে যতটুকু চিনি ও জানি, সে মোরাল দিক থেকে স্ট্রং একজন লেডি ছিল। তার চিন্তাচেতনা, ধ্যানধারণা—সবকিছুতে দৃঢ়তা ছিল। সে গত ১৭ বছর যাবৎ মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে চাকরি করে। শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেছে। পরে সে তার যোগ্যতা অনুসারে বিদ্যালয় শাখার কো-অর্ডিনেটর হয়। সব সময় তার চিন্তা ছিল, যত দিন বেঁচে থাকি সৎ কর্ম করে দেশের মানুষের যদি একটু উপকার হয়, সে ধরনের কাজে যুক্ত থাকব। এই দৃষ্টিভঙ্গি তার মধ্যে সব সময় কাজ করত।’

ওই দিনের ঘটনা বর্ণনা করে মনসুর হেলাল বলেন, ‘আমার ভাবিও মাইলস্টোনে চাকরি করেন। তিনি ফোন করে জানান, মাহেরীন যে শ্রেণির কো-অর্ডিনেটর, সেখানে একটি বিমান ক্রাশ করেছে। আমার বড় ছেলে আয়ানকে ফোন করে বলি। ছেলে যাওয়ার মাঝপথে জানতে পারে, তার মাকে উত্তরার বাংলাদেশ আধুনিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু সে তার মাকে পায়নি। পরে অ্যাম্বুলেন্স থেকে জানানো হয়, ওকে বার্ন ইউনিটে নিয়ে যাচ্ছে।’

মাহেরীন চৌধুরী

মাহেরীন চৌধুরীছবি: ফেসবুক থেকে

বার্ন ইউনিটের পাঁচতলায় গিয়ে মাহেরীন চৌধুরীকে পান বলে জানান মনসুর হেলাল। তিনি বলেন, ‘দেখলাম মাহেরীনের পা থেকে মাথা, চুল পর্যন্ত পুড়ে অঙ্গার হয়ে গেছে। সে আমাকে দেখার পরে বলে, “তুমি আসছো।” আমি বললাম, আসছি। বলে, “আমি থাকব না। আমাকে তুমি আমার বাবা-মায়ের কাছে নিয়ে যাও।” এরপর স্তব্ধ হলো। আমরা সবাই মিলে আইসিইউতে নিয়ে গেলাম। ও “আমি আর বেশিক্ষণ নেই” বলে আমার ডান হাত শক্ত করে ধরে তার বুকের ওপর রেখে বলল, “আমি চলে যাচ্ছি, জীবনে তোমার সঙ্গে আর কখনো দেখা হবে না।”’

স্ত্রীর সঙ্গে সর্বশেষ কথোপকথনের ঘটনা জানিয়ে মনসুর হেলাল বলেন, ‘আরেকটা জিনিস সে চাইছিল, বলে, “আমার খুব খিদা লাগছে। আমাকে কিছু খাবার দাও।” শুধু তিন ফোঁটা পানি দিতে পারছিলাম। অন্য কোনো খাবার তাঁকে দিতে পারি নাই। চিকিৎসক বলেছিলেন, কিছু খেতে দিলে শ্বাসনালিতে আটকে যেতে পারে। এই কষ্ট সারা জীবন থাকবে। আমি তাঁর মুখে কিছু দিতে পারি নাই।’ একপর্যায়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন মনসুর হেলাল। বড় ছেলে আয়ান রশিদ (১৬) ও ছোট ছেলে আদিল রশিদ (১৪) বাবার পাশে নির্বাক দাঁড়িয়ে ছিল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *