জটিলতার আবর্তে ‘আগামীর বন্দর’

একনেকে সাড়ে ১৩ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প অনুমোদন হয়েছে। হয়েছে আরো বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত। কিন্তু অর্থায়নের প্রক্রিয়া সম্পন্ন না হওয়ায় জটিলতার আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে চট্টগ্রাম বন্দরের বহুল প্রত্যাশিত বে টার্মিনাল নির্মাণ প্রকল্প। দেশের সমুদ্র বাণিজ্যে নতুন দিগন্ত উন্মোচনের স্বপ্ন নিয়ে ২০১৩ সালে হাতে নেওয়া হয় ‘আগামীর বন্দর’ খ্যাত বে টার্মিনাল প্রকল্প। কিন্তু এক যুগ পেরিয়ে গেলেও প্রকল্পটির অবকাঠামোগত নির্মাণকাজ বা মাঠপর্যায়ের কাজ সেই তিমিরেই পড়ে রয়েছে। অথচ ১৩ মিটার ড্রাফটের যে–কোনো দৈর্ঘ্যের জাহাজ ভিড়ার উপযোগী এ টার্মিনাল জোয়ার–ভাটার প্রভাব ছাড়াই ২৪ ঘণ্টা পরিচালিত হতে পারে। দেশের বন্দর অবকাঠামো উন্নয়নে যুগান্তকারী ভূমিকা রাখবে বলে বিভিন্ন সমীক্ষায় উল্লেখ করা হয়েছে।

বন্দর সূত্র জানিয়েছে, হালিশহর এলাকার বঙ্গোপসাগরের উপকূলের ৯৩৯ একর ভূমির উপর বে টার্মিনাল নির্মাণ প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। শুরুতে ৬৮ একর ব্যক্তি মালিকানাধীন ভূমি হুকুমদখল করা হয়। বন্দর কর্তৃপক্ষ এই ভূমির মূল্য পরিশোধ করে দখল বুঝে নেয়ার পর কার্যক্রম শুরু করে। উক্ত ৬৮ একর ভূমিতে বাউন্ডারি ওয়াল এবং রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণের পর ট্রাক টার্মিনাল নির্মাণের কাজও চলে। ৬৮ একর ব্যক্তি মালিকানাধীন ভূমির পেছনে সাগর থেকে আরো অন্তত ৫শ একর ভূমি উদ্ধারের কাজ শুরু হবে। এই প্রকল্পে সাগর থেকে মোট ১৬শ একর ভূমি রিক্লেইম করা হবে। সিঙ্গাপুরের আদলে সাগর ভরাট করে উদ্ধার করা ভূমিতে নির্মিত হবে বে টার্মিনালের অবকাঠামো। এটি দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় রিক্লেইম হবে বলে মন্তব্য করেছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। হামবুর্গ পোর্ট কনসালটেন্ট (এইচপিসি) সেলহর্ন এবং বাংলাদেশের কেএস নামের বিশেষজ্ঞ প্রতিষ্ঠান বছরব্যাপী সার্ভে করে বে টার্মিনালের ব্যাপারে যে রিপোর্ট উপস্থাপন করেছে, তাতে সাগর ভরাট করে ভূমি উদ্ধার করে স্ট্রাকচার এবং সুপার স্ট্রাকচার নির্মাণের বিষয়টি রয়েছে।

ব্যক্তি মালিকানাধীন ৬৮ একর ভূমির পাশাপাশি সরকারের খাস খতিয়ানভুক্ত ৫০০ একর জমিও বে টার্মিনালের জন্য বরাদ্দ দেয়া হয়। কিন্তু এখনো ৩০৩ একর ভূমি অধিগ্রহণ বাকি রয়েছে। এই ভূমি পাওয়ার পর সাগর ভরাট করে জমি উদ্ধার করা হবে। প্রায় আড়াই হাজার একর ভূমিতে বে টার্মিনাল নির্মাণের কথা রয়েছে। প্রকল্পটি একনেক থেকে অনুমোদন এবং ব্রেকওয়াটারসহ অবকাঠামো উন্নয়নে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নের অনুমোদন মিলেছে। কিন্তু এখনো মাঠপর্যায়ে দৃশ্যমান কোনো কাজ শুরু হয়নি।

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের শীর্ষ কর্মকর্তারা বলেছেন, প্রকল্পের ডিটেইলড ডিজাইনের কাজ চলছে। এ কাজ শেষ হলেই মাঠপর্যায়ে কাজ শুরু হবে।

বে টার্মিনাল প্রকল্পটি দেশের আমদানি–রপ্তানি বাণিজ্যে গতি আনার পাশাপাশি দেশের অর্থনীতিতে বড় ভূমিকা রাখবে। জিডিপিতে এই প্রকল্পের ভূমিকা দৃশ্যমান হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন বিশেষজ্ঞরা। বে টার্মিনাল চট্টগ্রাম বন্দরের ক্রমবর্ধমান চাপ কমাবে উল্লেখ করে বিশেষজ্ঞ সূত্রগুলো জানায়, সময় যত গড়াচ্ছে, প্রকল্প ব্যয় ততই বৃদ্ধি পাবে।

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ‘বে টার্মিনাল মেরিন ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট’ (বিটিএমআইডিপি) নামে যে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে, তাতে চ্যানেল নির্মাণ, ব্রেকওয়াটার, রেল ও সড়ক সংযোগসহ সব অবকাঠামো উন্নয়ন করা হবে। প্রকল্পের প্রাথমিক বাজেট ধরা হয়েছে প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে বিশ্বব্যাংক ১০ হাজার কোটি এবং চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ৪ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করবে।

প্রকল্পের আওতায় ব্রেকওয়াটার নির্মাণে ৮ হাজার ২৬৯ কোটি ৮৫ লাখ, নেভিগেশন চ্যানেল নির্মাণে ১ হাজার ৯৭৯ কোটি ৪৫ লাখ, নেভিগেশনে সহায়ক যন্ত্র স্থাপনে ৫৭ কোটি ৭০ লাখ এবং রেল ও সড়ক সংযোগে ৩ হাজার ৪৩৪ কোটি ৬৮ লাখ টাকা ব্যয় ধরা হয়।

নগরীর হালিশহর উপকূল থেকে দক্ষিণ কাট্টলী রানি রাসমনি ঘাট পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ৬ কিলোমিটার এলাকায় নির্মিত হতে যাওয়া বে টার্মিনালে মোট তিনটি টার্মিনাল থাকবে। দুটি কন্টেনার টার্মিনালের একটি নির্মাণ করবে পিএসএ সিঙ্গাপুর এবং অন্যটি দুবাইয়ের ডিপি ওয়ার্ল্ড। জিটুজি চুক্তির আওতায় বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোর ওই দুটি টার্মিনাল নির্মাণ করার কথা। তৃতীয় টার্মিনালটি হবে মাল্টিপারপাস। সেটি চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের নির্মাণের কথা থাকলেও বিদেশি বিনিয়োগের কথাও বলা হয়েছে।

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এস এম মনিরুজ্জামান বেশ কিছুদিন আগে জানিয়েছিলেন, পিএসএ সিঙ্গাপুর ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, ডিপি ওয়ার্ল্ড ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং মাল্টিপারপাস টার্মিনালে আরো ২ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের সম্ভাবনা রয়েছে।

বন্দর সূত্রে জানা গেছে, ২০২৬ সালের জুনে নির্মাণকাজ শুরু হলে ২০৩০ সালে টার্মিনালটি অপারেশনে যেতে পারবে। কিন্তু প্রকল্প শুরু করতেই এক যুগ পার হওয়ায় আগামী বছরের মধ্যে এটির মাঠ পর্যায়ের কাজ শুরু করা নিয়ে সংশয় ব্যক্ত করা হয়েছে।

অবশ্য বন্দরের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা গতকাল আজাদীকে বলেন, আগামী বছর বে টার্মিনালের কাজ দৃশ্যমান হবে। মেজবানের মাংস রান্নার উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, জিনিসপত্র যোগাড় করতে বেশ প্রস্তুতি এবং সময় লাগে। কিন্তু চুলায় তুলে দেয়ার পর আর বেশি সময় লাগে না। বে টার্মিনালের সবকিছু গুছিয়ে আনা হচ্ছে।

বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ বছরে ৩২ লাখ টিইইউএসের বেশি কন্টেনার হ্যান্ডলিং করে। বে টার্মিনালে বছরে প্রায় ৫০ লাখ টিইইউএস কন্টেনার হ্যান্ডলিংয়ের সক্ষমতা থাকবে। এটি ‘আগামীর বন্দর’ মন্তব্য করে ওই কর্মকর্তা বলেন, বে টার্মিনালে জোয়ার–ভাটা, দিন–রাত, বাঁকা চ্যানেলের ঝামেলা থাকবে না। রাতে–দিনে যে–কোনো সময় যে–কোনো ল্যান্থের জাহাজ এই টার্মিনালে নোঙর করতে পারবে। এছাড়া ১৩ মিটার ড্রাফটের জাহাজ অনায়াসে বে টার্মিনালে ভিড়তে পারবে। বর্তমান বন্দর চ্যানেলে মাত্র ১৯০ মিটার দৈর্ঘ্য ও সাড়ে ৯ মিটার ড্রাফটের জাহাজ কর্ণফুলীতে প্রবেশ করতে পারে। সেক্ষেত্রে জাহাজকে দুটি বাঁক অতিক্রম করতে হয় এবং দিনের মাত্র চার ঘণ্টা সময় পাওয়া যায়। কিন্তু বে টার্মিনালে ২৪ ঘণ্টা জাহাজ পরিচালনা করা যাবে।

বর্তমানে যেসব ছোট ফিডার জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ট্রান্সশিপমেন্ট পোর্টে কন্টেনার পরিবহন করে বে টার্মিনালে এই ধরনের চার–পাঁচটি জাহাজের পণ্য একটি জাহাজ বহন করে আনা–নেয়া করবে। ল্যান্ড লর্ড পদ্ধতিতে পরিচালিত হতে যাওয়া বে টার্মিনাল চালু হলে দেশের গভীর সমুদ্রবন্দরের অভাব অনেকটা ঘুচে যাবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *