খেজুর রস যেন সোনার হরিণ

খেজুর রস ছাড়া শীতকাল যেন অপূর্ণ। ভাপা পিঠার সাথে খেজুর রস আর কুয়াশামাখা সকাল এসবই শীতের নিত্য অনুষঙ্গ। দিন বদলে গেছে। সময়ের পরিক্রমায় শীত আসে কিন্তু খেজুর রসের দেখা পাওয়া এখন সোনার হরিণের মতোই।

শীত আসলেই খেজুর রস দিয়ে নতুন নতুন চালের বাহারি পিঠা খাওয়া গ্রামীণ সংস্কৃতির ঐতিহ্যের একটা বড় অংশ ছিল। বিয়ের পর শীতকালে নববধূর বাড়ি থেকে জামাইর বাড়িতে খেজুর রস আর ভাপা পিঠা পাঠানো হত। গ্রামের ৯০ শতাংশের বেশি মানুষ হাজার বছর ধরে এই রেওয়াজ লালন করে আসছেন। এটাকে আত্মীয়তার বন্ধনের অন্যতম অংশ হিসেবেও বিবেচনা করা হয়। কিন্তু গত এক দশক ধরে গ্রামীণ জনপদে খেজুর রস অনেকটা বিলুপ্তির পথে। এতে হারিয়ে যেতে বসেছে চিরচেনা সেই রেওয়াজও। এক সময় গ্রামের প্রতি ঘরে ঘরে খেজুর গাছ থাকতো আর শরৎকালে নিজেদের রসের চাহিদা মিটিয়ে এলাকায় বিক্রি করতো। কয়েক যুগ ধরে ধীরে ধীরে কমতে থাকে খেজুর গাছ। এরই মাঝে এক দশক আগেও পাড়া–মহল্লায় শীতকালে খেজুর রস বিক্রি করা হত অনেকটা কম মূল্যে। এলাকার মানুষ পালা করে করে খেজুর গাছের মালিকদের কাছ থেকে রস কিনতেন। কিন্তু বর্তমানে পুরো গ্রামে খেজুর গাছ আর রস চোখেই পড়ে না।

এদিকে খেজুর গাছ কমলেও কমেনি খেজুর রসের গ্রাহক সংখ্যা। কমেনি এর কদরও। খেজুরের রস ও খেজুরের মিঠা তাই চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলা বা দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এখন অনলাইনে মিঠা সংগ্রহ করে চাহিদা পূরণ করেন। তবে এক্ষেত্রে সাধারণ মানুষ নানাভাবে প্রতারিত হচ্ছেন বলেও জানা গেছে।

আনোয়ারা উপজেলার ১১ ইউনিয়নের মধ্যে বরুমচড়া, বারখাইন, হাইলধর, পরৈকোড়া, জুঁইদন্ডি, রায়পুর, চাতরি, বটতলী, বৈরাগ, বারশত ও আনোয়ারা সদর ইউনিয়নে খেজুর গাছ অনেকটা বিলুপ্তির পথে বললেই চলে। কিছু কিছু গ্রামে রস পাওয়া গেলেও তা চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল আর দামও অনেক বেশি। তাই গ্রামের মানুষকে এখন রসের পরিবর্তে বাজারের মিঠাই দিয়ে রসের চাহিদা মেটাতে হচ্ছে। অনেকটা দুধের স্বাদ ঘোলে মিটানোর মতন।

২০ বছর আগে যেখানে খেজুর রসের মূল্য ছিল প্রতি কেজি ১৫ থেকে ২০ টাকা, সেখানে এখন প্রতি কেজি খেজুর রস ১৫০ থেকে ১৭০ টাকায় মিলছে না। গ্রামীণ জনপদে এভাবে খেজুর রসের বিলুপ্তি হলে আগামী ১০ বছর পর আনোয়ারায় খেজুর রস পাওয়া যাবে তা নিয়ে সন্দেহ তৈরি হয়েছে। তাই স্থানীয়রা গ্রামীণ ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে সরকারি–বেসরকারি উদ্যোগে খেজুর গাছ রোপণের দাবি জানিয়েছেন।

আনোয়ারা উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে সরজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, গ্রামীণ সড়কগুলোতে বিভিন্ন প্রজাতির গাছ দেখা গেলেও খেজুর গাছ নেই বললেই চলে। কোনো কোনো জায়গায় দুই একটা করে খেজুর গাছ দেখা গেলেও চাহিদার তুলনায় অনেক কম। স্থানীয়রা জানান, এক সময় গ্রামের সড়কের দুই পাশে সারি সারি অসংখ্য খেজুর গাছ ছিল। বিলের মাঝে, বাড়ির পুকুর পাড়েও খেজুর গাছের কমতি ছিল না। কিন্তু কালের বিবর্তনে এখন খেজুর গাছ দেখা পাওয়া যেন সৌভাগ্যের বিষয়।

স্থানীয় বরুমচড়া ইউনিয়নের বাসিন্দা মো. হোসেন (৫৫) জানান, আনোয়ারায় খেজুর রসের জন্য বরুমচড়া এলাকা জনপ্রিয় ছিল। কিন্তু ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিলের ঘূর্ণিঝড়ের পর এলাকার অনেক খেজুর গাছ মরে যায়। এর পর থেকে ধীরে ধীরে কমতে থাকে। গত ১০ বছরে একেবারে কমে গেছে। এখনতো খেজুর রস পাওয়াই যাচ্ছে না।

স্থানীয় বাসিন্দা আশরাফ উদ্দীন চৌধুরী কুসুম বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন ছাড়াও গ্রামে এখন শহুরে ছোঁয়া লেগেছে। তাছাড়া অপরিকল্পিত শিল্পায়নের আগ্রাসনে প্রকৃতির ঐতিহ্য খেজুর গাছ হারিয়ে যাওয়ার আরেকটি কারণ। খামারি ইকবাল বাহার বলেন, নানা কারণে খেজুর গাছ কর্তন, দুর্যোগে মরে যাওয়া এবং নতুন চারা রোপণ না করার কারণে খেজুর গাছ বিলুপ্ত হচ্ছে।

মাদ্রাসা শিক্ষক মাওলানা ফফিজ উল্লাহ জানান, গত কয়েক বছর খেজুর রস এলাকায় পাইনি, তাই খেতেও পারিনি। কখন আল্লাহ রিজিকে রাখছে জানি না। তবে বাজারের মিঠা দিয়ে রসের চাহিদা পূরণের চেষ্টা চলে এখন।

আনোয়ারা সদরের বাসিন্দা মুক্তিযোদ্ধা রফিক আহমদ জানান, তিনি দুইটি খেজুর গাছ রস সংগ্রহের জন্য পরিষ্কার করেছেন। তবে রস তেমন পাওয়া যায় না। দুইটি গাছে ৪/৫ কেজি রস পাওয়া যায়। আগামী সপ্তাহে রস সংগ্রহ করতে পারবেন বলে তিনি জানান।

জানতে চাইলে আনোয়ারা উপ–সহকারী কৃষি কর্মকর্তা সরোয়ার আলম জানান, আমাদের ঊঠান বৈঠক সমূহে আমরা কৃষকদের খেজুর গাছ লাগানোর পরামর্শ দিয়ে থাকি। তবে এ ব্যাপারে আমাদের আলাদা কোনো প্রকল্প নেই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *