সম্প্রতি, শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ এবং নেপালের মতো দেশগুলিতে গণবিক্ষোভের পর সরকার পতন হয়েছে, আর মালয়েশিয়ায় এখনো বিক্ষোভ চলছে। এশিয়ার বিভিন্ন দেশে দুর্নীতির প্রতিবাদে অস্থিরতা বাড়ছে, এবং এর পেছনে মূল কারণ ক্ষমতাসীনদের দুর্নীতি, যার অধিকাংশই পাচার করা হয়েছে যুক্তরাজ্যে।
যুক্তরাজ্যের ভূমিকা: অর্থ পাচারের কেন্দ্রবিন্দু
মালয়েশিয়া, বাংলাদেশ এবং অন্যান্য দেশের তদন্তকারীরা এই পাচারকৃত অর্থের সুরক্ষায় ব্রিটেনের ভূমিকা নিয়ে নতুন করে ভাবছেন। ব্রিটেনের লন্ডন শহর বহু দশক ধরে দুর্নীতিগ্রস্তদের জন্য বৈধতার আড়ালে একটি নিরাপদ বিনিয়োগ কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। বিলাসবহুল সম্পত্তি বাজারের মাধ্যমে এসব দেশের নেতারা অবৈধ অর্থ লন্ডনে স্থানান্তর করে আসছেন, যা এখন বৈশ্বিক দুর্নীতির একটি প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
মালয়েশিয়া ও বাংলাদেশে দুর্নীতি: ব্রিটেনের শরণাপন্ন
মালয়েশিয়া, বিশেষ করে সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদের বিরুদ্ধে লন্ডনে থাকা সম্পদের তদন্ত শুরু হওয়ার পর, ব্রিটেনের ভূমিকাকে নতুন করে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে। গত জুনে, মালয়েশিয়ার দুর্নীতি দমন কমিশনের অনুরোধে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ ১৮০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের সম্পত্তি জব্দ করেছে। এর মধ্যে রয়েছে লন্ডনের সিটি এলাকার বাণিজ্যিক ভবন এবং বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট।
বাংলাদেশেও একই চিত্র। সম্প্রতি, ইউকের ন্যাশনাল ক্রাইম এজেন্সি (এনসিএ) শেখ হাসিনার সহযোগীদের মালিকানাধীন ৯০ মিলিয়ন পাউন্ড মূল্যের বিলাসবহুল সম্পত্তি জব্দ করেছে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল ইউকে-এর অনুসন্ধানে আরও ৪০০ মিলিয়ন পাউন্ড মূল্যের সম্পত্তি উদ্ধার হয়েছে, যার মধ্যে মেফেয়ার, সারে ও মার্সিসাইডের প্রাসাদও রয়েছে।
ব্রিটেনের আইনি দুর্বলতা ও আন্তর্জাতিক চাপ
ব্রিটেনের আইনি ব্যবস্থা এই অর্থ পাচারের ক্ষেত্রে এখনও দুর্বল। যদিও ২০১৮ সাল থেকে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট তার আইনগুলোতে স্বচ্ছতার প্রবর্তন করার চেষ্টা করছে, তবুও ক্যারিবীয় অঞ্চলের ব্রিটিশ ওভারসিজ টেরিটরি (যেমন কেম্যান আইল্যান্ডস এবং ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডস) এখনো পাচারের প্রধান কেন্দ্র হিসেবে কাজ করছে। এই অঞ্চলে গত ৩০ বছরে ৭৯টি দেশের প্রায় ২৫০ বিলিয়ন পাউন্ডের অবৈধ অর্থ পাচার হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক ক্ষতি
এছাড়া, জাতিসংঘের মাদক ও অপরাধবিষয়ক কার্যালয় (ইউএনওডিসি) অনুমান করছে, উন্নয়নশীল দেশগুলো প্রতি বছর দুর্নীতির কারণে ৪০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার হারায়। দুর্নীতির এই বিশাল অঙ্কের প্রভাব সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর অর্থনীতিতে গভীর ক্ষত তৈরি করছে।
এশিয়ায় দুর্নীতির প্রতিবাদ: নতুন রাজনৈতিক ঢেউ
নেপাল, ইন্দোনেশিয়া এবং অন্যান্য এশীয় দেশগুলোতে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জনগণের বিক্ষোভ চলছে। এসব আন্দোলনের মধ্যে রয়েছে রাজনৈতিক অভিজাতদের বিরুদ্ধে অভিযোগ। এই বিক্ষোভগুলি এশিয়ায় পরিবর্তনের একটি নতুন ঢেউ সৃষ্টি করেছে, যা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বড় ধরনের মনোযোগ আকর্ষণ করছে।
বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রভাব
এশিয়ার বিভিন্ন দেশে দুর্নীতির বিরুদ্ধে চলমান আন্দোলন এবং যুক্তরাজ্যে পাচারকৃত অর্থের বিষয়ে আন্তর্জাতিক চাপ বাড়ছে। এই ধরণের পরিস্থিতি বিশ্বব্যাপী ক্ষমতাসীনদের জবাবদিহির আওতায় আনার জন্য একটি শক্তিশালী দৃষ্টান্ত হতে পারে, যদিও ব্রিটেনের আইনি ব্যবস্থা এখনো সম্পূর্ণভাবে কার্যকর হয়নি।
নির্মিত দুর্ভাগ্যের প্রতীক: লন্ডন
আজও লন্ডনের আকাশচুম্বী ভবনগুলো ঝলমল করছে, কিন্তু এটি সেই দেশের জনগণের জন্য একটি চুরি করা স্বপ্নের ওপর নির্মিত দুর্ভাগ্যের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এশিয়ার কোটি মানুষের কাছে, যা এখন বিশ্বের ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে একটি আওয়াজ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।