চট্টগ্রাম রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলের (সিইপিজেড) অ্যাডামস ক্যাপস অ্যান্ড টেক্সটাইল লিমিটেড ও জিহং মেডিক্যাল কোম্পানির গুদামে লাগা ভয়াবহ আগুন গভীর রাত পর্যন্ত (গতকাল রাত সাড়ে ১টা পর্যন্ত; ১১ ঘণ্টা) নিয়ন্ত্রণে আসেনি। কারখানা দুটির সাততলা গুদাম থেকে আগুনের সূত্রপাত হলেও সন্ধ্যার পর থেকে ধীরে ধীরে আগুন ছড়িয়ে পড়ে পুরো ভবনেই। আগুনের তাপের কারণে ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা কাছে যেতে পারছেন না। দূর থেকে এক পাশে পানি দিয়ে আগুন নেভানোর চেষ্টা করছেন তাঁরা। এর মধ্যে আগুনের তীব্রতায় ৭ম তলা ভবনের একাংশ (ডানপাশের পুরো অংশ) ধসে পড়েছে। একই মালিকের পাশের তিনতলা ভবনে (দ্বিতীয় ইউনিটে) আগুন ছড়িয়ে পড়ে পুরোটাই ছাই হয়ে গেছে। দ্বিতীয় ইউনিটটি–বয়লার ইউনিট; সেখান থেকে থেমে থেমে বয়লার বিস্ফোরণ হচ্ছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুর ২টা ১০ মিনিটে সিইপিজেডের ১ নম্বর সেক্টরের ৫ নম্বর সড়কের অ্যাডামস ক্যাপস অ্যান্ড টেক্সটাইল লিমিটেড ও জিহং মেডিকেল কোম্পানির গুদামে আগুন লাগে। যা পরবর্তীতে পুরো ভবনে ছড়িয়ে পড়ে।
রাত ১১ টার দিকে ফায়ার সার্ভিস ও স্থানীয় প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন আগুনের তীব্র দাপদাহে ৭ম তলা মূল কারখানার ডান পাশের পুরো অংশ ধসে পড়েছে। ওইদিক থেকে পার্শ্ববর্তী বয়লার ইউনিটে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। বয়লার ইউনিট পুরোটাই পুড়ে ছাই হয়ে গেছে বলে জানান স্থানীয় প্রত্যক্ষদর্শী রিফাত ও আলমগীর।
ভয়াবহ এই আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে গভীর রাত পর্যন্ত ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের ৮টি স্টেশনের ২৩টি ইউনিট কাজ করছে বলে জানান
চট্টগ্রাম বিভাগীয় ফায়ার সার্ভিসের উপপরিচালক জসিম উদ্দিন। তিনি বলেন, ফায়ার সার্ভিসের পাশাপাশি নৌবাহিনীর কয়েকটি ইউনিটও আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে। একটানা ১১ ঘণ্টা ধরে চেষ্টা করেও রাত ১টা পর্যন্ত আগুন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসেনি।
কেমিক্যালের গুদামের আগুনে ভয়াবহতা বাড়ে : ফায়ার সার্ভিসের চট্টগ্রাম অঞ্চলের উপপরিচালক মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন বলেন, ভেতরে দাহ্য পদার্থ থাকায় আগুন নেভাতে বেগ পোহাতে হচ্ছে। কারখানাটির ৫ম তলা থেকে ৭ম তলা পর্যন্ত কেমিক্যালের গুদাম বলে জানা গেছে। সন্ধ্যার পর থেকে রাত পর্যন্ত কারখানার কেমিক্যালের আগুনের ভয়াবহতা বেড়ে যাওয়ায় থেমে থেমে কারখানাটির ভেতরে ছোট আকারে বিস্ফোরণ হচ্ছিল।
অ্যাডামস তোয়ালে, ক্যাপ এবং জিহং মেডিকেল সার্জিক্যাল গাউন তৈরির কারখানা দুটি গুদাম সাততলায়, যেখান থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়। আগুনের তাপের কারণে ভবনটির ১০০ মিটার পর্যন্ত কেউ যেতে পারছেন না। তাপের তীব্রতায় ভবনের ছাদ ধসে পড়ছে। এই ভবন থেকে আগুনের ফুলকি চারপাশে ছড়িয়ে পড়ছে।
পাশের ভবনে পানি ছিটিয়ে আগুন ছড়িয়ে পড়া রোধের চেষ্টায় ফায়ার সার্ভিস : এদিকে রাতে আগুনের তীব্রতা বেড়ে যাওয়ায় আশপাশের আরও কয়েকটি কারখানা ঝুঁকিতে রয়েছে বলে জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিস। ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা আশপাশের এসব ভবনে পানি ছিটিয়ে আগুন ছড়িয়ে পড়া রোধ করার চেষ্টা করছেন।
পার্শ্ববর্তী আল হামিদীয়া নামে একটি গার্মেন্টসসহ আরও কয়েকটি কারখানা কর্তৃপক্ষ নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় কারখানাগুলোর অভ্যন্তরে পানি ছিটিয়ে শীতল রাখার চেষ্টা করছে।
জানতে চাইলে ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক আনোয়ার হোসেন বলেন, আগুনের তাপের কারণে কারখানাটির কাছে যাওয়া যাচ্ছে না। এ কারণে আগুন নেভানোর পাশাপাশি ছড়িয়ে পড়া রোধ করতে কাজ করছেন তাঁরা। ভেতরে দাহ্য পদার্থ থাকায় আগুন নেভাতে বেগ পোহাতে হচ্ছে।
ধোঁয়ায় গন্ধ; অনেকেই অসুস্থ : একদিকে কেমিক্যাল অন্যদিকে মেডিকেল সার্জিকেল গাউন পুড়ে আশপাশের এলাকা ধোঁয়া আর গন্ধে ভারী হয়ে ওঠে। গন্ধে ফায়ার সার্ভিসের অনেক কর্মী অসুস্থ হয়ে পড়েন। এসময় আরও অনেকেই ধোঁয়া আর গন্ধে অসুস্থ হন।
এদিকে কারখানা দুটিতে আগুন লাগার পর আশপাশের কারখানাগুলোও বন্ধ ঘোষণা করেছে কর্তৃপক্ষ। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও এ এলাকায় কাউকে প্রবেশ করতে দিচ্ছে না।
চট্টগ্রাম রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলের (সিইপিজেড) নির্বাহী পরিচালক আবদুস সুবাহান জানান, অ্যাডামস ক্যাপস অ্যান্ড টেঙটাইল লিমিটেডে তোয়ালে ও ক্যাপ এবং জিহং মেডিকেল সার্জিকেল গাউন তৈরির কারখানা। কারখানার ভবনটি ৭ম তলা। দুটি কারখানার গুদামও সাত তলায়। এখান থেকেই আগুনের সূত্রপাত হয় বলে ধারণা করছে ফায়ার সার্ভিস। পরে এই আগুন ধীরে ধীরে ছয় ও পাঁচতলায়ও ছড়িয়ে পড়ে। ভবনটিতে মোট ৭০০ শ্রমিক কাজ করেন। আগুন লাগার সঙ্গে সঙ্গে শ্রমিকদের সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। তাই কেউ আহত কিংবা অগ্নিদগ্ধ হননি।
ফায়ার সার্ভিসের চট্টগ্রাম অঞ্চলের উপপরিচালক মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন বলেন, আগুন নেভাতে অনেক কষ্ট হচ্ছে আমাদের। ভেতরে কোনো শ্রমিক আটকে নেই বলে কারখানার মালিকপক্ষ আমাদের জানিয়েছে। তবে আমরা ভবনটির ৬ ও ৭ তলায় আটকে পড়া ২৫ জনকে উদ্ধার করেছি। তারা ধোঁয়ায় আটকা পড়েছিলেন। আমরা তাদের নিরাপদে সরিয়ে এনেছি। কী কারণে আগুনের সূত্রপাত হয়েছে কিংবা কী পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে সেটা তদন্ত ছাড়া বলা যাবে না।
আগুন নেভাতে কাজ করছে সিইপিজেড, বন্দর, কেইপিজেড ও আগ্রাবাদ ফায়ার স্টেশনের মোট ২৩টি ইউনিট এবং নৌ ও বিমান বাহিনীর চারটি ইউনিট। পরে যোগ দিয়েছেন দুই প্লাটুন বিজিবি সদস্যও।
রাত ১টার দিকে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত ফায়ার সার্ভিস ও নৌবাহিনীর সদস্যরা আগুন নেভাতে কাজ করছিলেন। আগুনের তীব্রতা এত বেশি ছিল যে ১১ ঘণ্টায়ও পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেননি তারা। চারপাশে ছড়িয়ে পড়েছে ঘন কালো ধোঁয়া। আগুন ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়েছে ৭ম তলা ভবনের নিচতলা পর্যন্ত। আগুনের তীব্রতায় আশপাশের আরও কয়েকটি কারখানা ঝুঁকিতে রয়েছে বলে জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিস।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা প্রায় অসহায় হয়ে পড়েছেন।
ইপিজেড থানার ওসি মোহাম্মদ জামির হোসেন জিয়া বলেন, অ্যাডামস ক্যাপ অ্যান্ড টেঙটাইল লিমিটেড নামের ওই কারখানায় লাগা আগুনের তীব্রতা বেড়েই চলেছে। বর্তমানে আগুন পুরো ভবনে ছড়িয়ে পড়েছে। প্রথমে ভবনের সপ্তম তলায় যেখানে আগুন লাগে সেখানে চিকিৎসা সরঞ্জাম তৈরি করা হয়। মূলত গুদাম থেকেই আগুনের সূত্রপাত হয়েছে বলে কারখানাটির সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। ওইখানে লোকজন ছিল না বলে জেনেছি। যারা নিচের তলায় ছিল তারা বেরিয়ে এসেছে।
তিনি আরও জানান, ফায়ার সার্ভিসের পাশাপাশি নৌবাহিনী ও বিমান বাহিনীর ফায়ার ইউনিট আগুন নেভাতে কাজ করছে। সহযোগিতা করছে সেনাবাহিনী, বিজিবি ও পুলিশ।
সরেজমিনে গতকাল বিকেল থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত কারখানা এলাকায় দেখা যায়, ফায়ার সার্ভিস ও নৌবাহিনীর সদস্যরা আগুন নেভাতে কাজ করছেন। চারপাশে ছড়িয়ে পড়েছে ঘন কালো ধোঁয়া। আগুন ধীরে ধীরে ছয় ও পাঁচতলায় ছড়িয়ে পড়ছে।
আগুন দেখতে দুপুরের পর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত হাজার হাজার মানুষ ভবনটির আশপাশে ভীড় করেছিলেন; এসময় তাদেরকে সেনাবাহিনী ও নৌবাহিনীর সদস্যরা সরিয়ে দিচ্ছিলেন।
ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা বেশ কয়েজন শ্রমিককে নিরাপদে নামিয়ে আনতে দেখা গেছে। এসময় ধোঁয়ায় অসুস্থ হয়ে পড়া একজন নারী শ্রমিককে গাড়িতে তুলতে দেখা গেছে। আগুনের ধোঁয়ায় কারখানার ওই শ্রমিক অসুস্থ হয়েছেন বলে জানান কারখানার অপর শ্রমিক জান্নাতুল ও মন্নান।
জি হং মেডিকেল কোম্পানির শ্রমিক জোবেদা বেগম ও শিপা বলেন, তারা পাঁচতালায় কাজ করছিলেন। দুপুরে খাওয়ার পর ‘আগুন, আগুন’ বলে চিৎকার করে ওপর থেকে অনেককে নামতে দেখেন। এ চিৎকার শুনে তারাসহ সবাই দৌঁড়ে নিচে নেমে আসেন।
জি হং মেডিকেল কোম্পানির সুপারভাইজার ফাহিমুল মাহমুদ ভূঁইয়া বলেন, আমি চারতলায় ছিলাম। দুপুরের দিকে হঠাৎ জরুরি অ্যালার্ম বাজতে শুনি। এরপর জানতে পারি, আগুন লেগেছে। কারখানার সবাই নিরাপদে নেমে গেছেন। কারখানাটিতে হাসপাতালে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি ও তোয়ালে তৈরি করা হতো।