যশোর-খুলনা মহাসড়কের কোলঘেঁষে রামনগর নামের স্থানের কথা মানুষ বহুদিন ধরে আক্ষেপ আর মুগ্ধতার সঙ্গে উচ্চারণ করেÑ তার মধ্যে লুকিয়ে আছে এক অনন্য ইতিহাস। এখানে দাঁড়িয়ে থাকা ‘ক্ষণিকা পিকনিক কর্নার’ যেন এক সময়ের সতেজ স্মৃতি, যেখানে বিনোদন, প্রকৃতি আর ঐতিহ্য মিলেমিশে গড়ে উঠেছিল মানুষের প্রাণের মুখরতা। আর এই পিকনিক কর্নারের কেন্দ্রবিন্দুই হলো প্রাচীন এক বিশাল দীঘি, যার আকাশভরা জলরাশি আজও ইতিহাসের প্রতিধ্বনি বহন করে।
শাহাবাটির দীঘি বা হিন্দুদীঘি নামে পরিচিত জলাশয়টির ইতিহাস বিস্ময় জাগায়। কথিত আছে, খান জাহান আলীর সময় খনন করা এই দীঘি ৫৬ বিঘা জমিজুড়ে বিস্তৃত। প্রাচীন নিয়ম অনুযায়ী হিন্দুরা উত্তর-দক্ষিণে আর মুসলমানরা পূর্ব-পশ্চিমে দীঘি খনন করতেন। কিন্তু সতীশচন্দ্র মিত্রের বর্ণনায়Ñখান জাহান আলী সেই প্রচলিত নিয়ম ভেঙেই উত্তর-দক্ষিণমুখী এই দীঘি নির্মাণ করেন। ফলে জলাশয়টি আজও রহস্যময় নাম ‘হিন্দুদীঘি’ হিসেবে পরিচিত। সেই দীঘির জল এখনো নিঃশব্দে ধরে রেখেছে বহু অনুচ্চারিত গল্প।
শীত এলেই এখানে নেমে আসে অতিথি পাখির দল। তাদের কিচিরমিচির শব্দে চারপাশের নীরবতা ভেঙে যায়, আর রামনগরের পরিবেশ হয়ে ওঠে এক স্বপ্নময় আবাসভূমি। দীঘির চারপাশ ঘেরা হাজারো বৃক্ষ যেন পাখিদের স্বর্গরাজ্য। বসন্ত এলে পাতা-ফুলে জেগে ওঠে ঘুমন্ত গাছগুলো, আর বাতাসে ভেসে বেড়ায় রঙের স্নিগ্ধতা। এক সময় ছুটির দিনে পরিবার, বন্ধু, প্রতিবেশী সবাই এখানে আসত সময় কাটাতে, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কাছে নিজেকে হারাতে।
তবে এই সৌন্দর্যের রাজ্য এখন অস্তিত্ব সংকটে। যে ক্ষণিকা পিকনিক কর্নার এক সময় দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের অন্যতম বিনোদন কেন্দ্র ছিল, তা আজ অযতেœর গ্লানিতে অবহেলার স্তূপে পরিণত হয়েছে। ঘাসে ঢাকা পথ, ভাঙা বসার জায়গা, অগোছালো পরিবেশ আর আবর্জনার স্তূপ সব মিলিয়ে হারাতে বসেছে এখানকার সেই জাদুকরী আবহ। যে মহাসড়ক দিয়ে প্রতিদিন হাজারো মানুষ যাতায়াত করেন, তাদের চোখে ধরা পড়ে কেবল একটি অবহেলিত ঐতিহ্যের বুকভাঙা ছবি।
যশোরের সচেতন নাগরিক সমাজ তাই বহুকাল ধরে দাবি জানিয়ে আসছে, সড়ক ও জনপথ বিভাগ যদি একটু দায়িত্ব নেয়, তবে ছয় দশকের এই পিকনিক কর্নারটি আবারও ফিরে পেতে পারে তার হারানো প্রাণ। আধুনিকায়নের মাধ্যমে এখানে তৈরি হতে পারে শৈল্পিক অবকাঠামো, পরিচ্ছন্ন ও আকর্ষণীয় পরিবেশ, হাঁটার পথ, বসার জায়গা, পিকনিক স্পট, শিশুদের খেলার স্থান আর সবচেয়ে বড় কথা, রক্ষা পাবে যশোরের একটি ঐতিহ্যবাহী জলাশয়।
রামনগরের ক্ষণিকা পিকনিক কর্নার শুধু বিনোদন কেন্দ্র নয়; এটি যশোরের মানুষের স্মৃতিবহনকারী এক মূল্যবান অধ্যায়। যে দীঘি শতাব্দীর ইতিহাস ধরে রেখেছে, যে বৃক্ষরাজি পাখিদের আশ্রয় দেয়, যে জায়গা এক সময় মানুষের আনন্দমুখরতা ধারণ করত, সেই স্থানকে ফিরিয়ে আনাই এখন সময়ের দাবি। কারণ ঐতিহ্য ধরে রাখাই তো ভবিষ্যতকে সমৃদ্ধ করার প্রথম শর্ত।