৭৫ বছর বয়সেও মাইলের পর মাইল দৌড়ান নৃপেন চৌধুরী

বছর দশেক আগের কথা। ব্যবসা থেকে অবসর নিয়ে তখন নির্ভার জীবন পার করছেন নৃপেন চৌধুরী। একদিন টিভিতে দেখেন, একই রকম টি–শার্ট পরে দৌড়াচ্ছেন একদল লোক। তাঁদের পায়ে লাল, নীল, হলুদ, সবুজ রঙের বাহারি সব জুতা। তাঁর কৌতূহল হলো। ইন্টারনেটে ঘাঁটাঘাঁটি করে জানলেন, এটার নাম ম্যারাথন। সিদ্ধান্ত নিলেন, তিনিও ম্যারাথনে দৌড়াবেন। কিন্তু এর জন্য তো চাই ফিটনেস। অথচ ফিটনেস নিয়ে কোনো হেলদোল এত দিন তাঁর ছিল না।

ফিটনেস বাড়াতে চট্টগ্রামের সিআরবি এলাকায় দৌড়াদৌড়ি শুরু করলেন নৃপেন চৌধুরী। প্রথম দিন একটু দৌড়েই কাহিল হয়ে পড়লেন। ‘প্রথম দিন আধা কিলোমিটারও দৌড়াতে পারিনি। দাম বন্ধ হয়ে আসছিল। মনে হয়েছিল, আমি পারব না,’ নৃপেন চৌধুরী বলছিলেন। তাঁর শ্বাসকষ্ট ছিল, সেটাই কাবু করল বেশি। বাসায় ফিরে ইউটিউবে ঘাঁটাঘাঁটি শুরু করলেন। ‘ইন্টারনেটকে শিক্ষক বানিয়ে ফেললাম। জানতে পারলাম, শুরু করতে হয় হালকা জগিং দিয়ে। একবারে কয়েক কিলোমিটার দৌড়ানো যায় না। ধীরে ধীরে বৈজ্ঞানিক উপায়ে দৌড়ের গতি থেকে দৈর্ঘ্য বাড়াতে হয়।’ কীভাবে দৌড় শুরু করতে হয়, কীভাবে ধীরে ধীরে দূরত্ব বাড়াতে হয়, দেখে দেখে শিখলেন। দৌড়ের পোশাক বা জুতার ভূমিকাও পড়ে পড়ে শিখলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের এই প্রাক্তন ছাত্র।

অথচ স্কুলে নৃপেন চৌধুরীর বাবাই কিন্তু ছিলেন শরীরচর্চার শিক্ষক। ছোটবেলায় কিছুদিন বাবার সঙ্গে যোগব্যায়ামও করেছেন। তবে দৌড়ানোর অভ্যাস গড়ে ওঠেনি। দ্রুত হাঁটার অভ্যাস অবশ্য ছিল। তাঁর স্বাভাবিক হাঁটার সঙ্গে তাল মেলাতে পারতেন না বন্ধুরা। অনেকে বিরক্ত হয়ে ধীরে হাঁটার পরামর্শও দিতেন। তবে সেসব তো যৌবনের শুরুর দিকের গল্প।

যে বয়সে এসে সবাই দৌড়াঝাঁপ বন্ধ করে কিছুটা ধীরস্থির হন, সেই বয়সে এসে নৃপেনের এই দৌড় শুরুর উৎসাহ তাই পরিবারের মানুষদেরও কৌতূহলী করে তোলে। তাঁদের মধ্যে তাঁর দুই কন্যাও আছেন।নিজেকে নতুনভাবে আবিষ্কারের নেশায় মেতে উঠলেন নৃপেন চৌধুরী। কাছাকাছি দেশে কোনো ম্যারাথন ইভেন্টের খোঁজ না পেয়ে ভারতের কলকাতায় একটি ম্যারাথনে নাম লেখালেন। দৌড়াতে গিয়ে দেখলেন, হাজার হাজার মানুষ, ঠিক টিভিতে দেখা সেই ম্যারাথনের মতো। কেউই নৃপেনের পরিচিত নন। তারপরও ১০ কিলোমিটারের সেই দৌড় শেষ করলেন ১ ঘণ্টা ৩ মিনিট ৪১ সেকেন্ডে। প্রথমবার টানা ১০ কিলোমিটার দৌড়ে নিজের ভেতরে ‘এক নতুন নৃপেনকে আবিষ্কার’ করলেন।

২০১৭ সালে স্ত্রী মিতা চৌধুরীসহ মেয়েদের কাছে ঢাকায় চলে আসেন। এর পর থেকে ঢাকার মানিক মিয়া এলাকায় দৌড়ান। এই দৌড়াতে গিয়েই বিডি রানার গ্রুপের সঙ্গে পরিচয়। ধীরে ধীরে দলটির সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করলেন। একই সঙ্গে দেশ–বিদেশে নানা ইভেন্টে অংশ নিতে থাকলেন। এ পর্যন্ত ১০, ২১, ২৫, ৪২ ও ৫০ কিলোমিটারের মোট ১৫২টি ইভেন্টে দৌড়েছেন নৃপেন চৌধুরী। দৌড় শুরু করার আগে শ্বাসকষ্ট, সর্দিতে নাক বন্ধ হয়ে থাকার যে সমস্যাগুলো ছিল, সেসবও নির্বাসনে চলে গেছে অনেক দিন। ৬৫ বছরের তুলনায় ৭৫ ছুঁই ছুঁই বয়সে এসে এখন আরও সচল নৃপেন চৌধুরী।২০২৩ সালে শিকাগো ম্যারাথন সম্পন্ন করেন নৃপেন চৌধুরী। বিশ্বের সবচেয়ে বড় ৭টি ম্যারাথন ইভেন্টের একটি এই শিকাগো ম্যারাথন। ভারতের নৈনিতালে অনুষ্ঠিত আলট্রাম্যারাথনও (৫০ কিলোমিটার) সম্পন্ন করেছেন তিনি।

এই বয়সে এসে নৃপেন চৌধুরীর আত্মবিশ্বাস যেন আগের চেয়ে বাড়ছে, ‘২৫০টি ম্যারাথন সম্পন্ন করার ইচ্ছা আছে। সুস্থ থাকতে শরীরকে সচল রাখার কোনো বিকল্প নেই। যে বয়সে আমার বন্ধুদের বেশির ভাগই আর বেঁচে নেই, সেই বয়সে এসে আমি নতুনভাবে বাঁচার আগ্রহ পাচ্ছি। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত আমি দৌড়ে যেতে চাই। সবচেয়ে ভালো লাগবে, যদি দৌড়াতে দৌড়াতেই আমার মৃত্যু হয়।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *