শিশুরা রাগ প্রকাশ করা শেখে বড়দের কাছ থেকে। আমিও মায়ের কাছেই শিখেছিলাম। আম্মু বলতেন, ‘যখন কারও ওপর রাগ হবে, তখন তাকে “তুমি একটা ফুল”, “পাখি”, “নদী”, এসব বলে বকা দেবে।’ ছোট্ট আমি ভাবতাম, এগুলোই বুঝি রাগ প্রকাশের ভাষা! মায়ের এই ব্যতিক্রমী শিক্ষাই আমার জীবনে গভীরভাবে প্রভাব ফেলেছে। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনার গণ্ডি পেরিয়ে এখন আমি একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করছি। জীবনের অনেকটা পথ পেরিয়ে এসেছি, তবু মায়ের শেখানো সেই নম্রতা এখনো আমার আচরণে কিছুটা হলেও জড়িয়ে আছে। আমি এখন পর্যন্ত আমার ছোট ভাই বাদে অন্য কাউকে তুই করে বলতে পারি না, বন্ধুদের সঙ্গে ঠাট্টা-তামাশায় ‘বকা-গালি’ দিতে পারি না। এ কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুদের কাছ থেকে ‘সুশীল’, ‘নার্ড’ ডাক অহরহ শুনেছি।
স্কুল, কলেজে খুব বাধ্যগত থাকলেও প্রথমবারের মতো আমি মা-বাবার কথা অমান্য করি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সময়। একে তো মেডিকেল কোচিং করিনি; কারণ ডাক্তার হওয়ার কোনো প্যাশন আমার ছিল না। স্বপ্ন দেখতাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ব। তাই থ্রি ইডিয়েটস-এর ফারহানের বাসার মতো দৃশ্যের অবতারণা হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের কোচিংয়ে ভর্তি হওয়ার সময়। তাঁরা খুব মন খারাপ করলেও আমাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি কোচিংয়ে দিয়েছিলেন। পরে সুযোগ হয় নিজের পছন্দের জায়গাতেই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে স্নাতক-স্নাতকোত্তর করেছি। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় দুটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের কাজের সঙ্গে জড়িত ছিলাম। অনেক সময় ছুটির দিনেও ক্যাম্পাসে যেতে হতো। যাতায়াতে দেড়-দুই ঘণ্টা লাগত, আর আম্মুর চিন্তার শেষ থাকত না। মুখে বলতেন, ‘আজ থাক, যেতে হবে না।’ কিন্তু আমি জেদ ধরলে ঠিকই আমার জন্য খাবার রান্না করে দিতেন, টিফিন নিয়ে যেতে বলতেন। এমন নিরন্তর, নিঃস্বার্থ ভালোবাসা মনে হয় শুধু মায়েরাই দিতে পারেন।
অন্য সবার কাছে ‘ভদ্র’ আমি কেন জানি মায়ের সঙ্গেই দুনিয়ার সব হতাশা, রাগ, ক্ষোভ কোনো চিন্তা ছাড়াই ঝাড়তে থাকি। শুধু মায়ের কাছেই কি সন্তানেরা তাদের ‘আনফিল্টারড ভার্সন’ প্রকাশ করে? কী জানি! যা বলা উচিত তা বলি না, আবার যা বলা উচিত নয় তা অক্লেশে বলে ফেলি। আমাকে এই পৃথিবীতে আনার জন্য, ছোট থেকে এত আদর, স্নেহ, ভালোবাসা দিয়ে বড় করার জন্য, পরীক্ষার আগে আমার গল্পের বইয়ের বান্ডিল লুকিয়ে রাখার জন্য, বকা দেওয়ার শব্দ ‘ফুল’, ‘নদী’ ইত্যাদি শিখিয়ে আমার মাতৃভাষাকে এত মিষ্টি রাখার জন্য, প্রয়োজনের সময় শাসন করার জন্য, মেয়ে বলে কোনো কিছু থেকে আমাকে বঞ্চিত না করার জন্য এবং আরও অসংখ্য আত্মত্যাগের জন্য তোমার প্রতি অসীম কৃতজ্ঞতা মা। মুখে বলা হয় না বলেই হয়তো আজ কলম তুলে বলছি—তোমাকে অনেক ভালোবাসি।