রানওয়ের আলো ঝলমলে পরিসর। স্পটলাইটের নিচে দৃষ্টিনন্দন পোশাকে আত্মবিশ্বাসে ভরপুর মডেলদের দৃপ্ত পদচারণা। তাদের প্রতিটি ছন্দ যেন বলছে একেকটি গল্প— রঙ, নকশা আর কাপড়ে বোনা জীবনের গল্প। এই ঝলমলে আলোয় আলোকিত শুধু ফ্যাশন নয়, আলোকিত কিছু জীবনও— যাদের প্রাত্যহিক সংগ্রাম এখন আলোয় ভরা নতুন এক রানওয়ে।
আজ আমরা সেই গল্পই শোনাতে চাই—বেরাইদের ঋষিপাড়া থেকে শুরু হওয়া ‘সত্তা’র গল্প।
বেরাইদ বয়ান: শিকড়ে ফিরে দেখা
ঢাকার প্রাচীন অঞ্চল বেরাইদ— বালুনদীর তীরে গড়ে ওঠা এক ঐতিহ্যবাহী জনপদ। একসময় এখানে মোগল আমলের ব্যবসা–বাণিজ্যের কেন্দ্র গড়ে উঠেছিল। সেই ঐতিহ্যের ধারক আজকের বেরাইদেও বসবাস করছে কিছু প্রান্তিক মানুষ—যাদের অধিকাংশই ঋষি সম্প্রদায়ের।
চামড়ার কাজ, জুতার সেলাই, স্যান্ডেল তৈরিই তাদের জীবনজীবিকা। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কমেছে কাজের সুযোগ, বেড়েছে অনিশ্চয়তা।
সুদিনের সূচনা: সত্তার জন্ম
এই প্রান্তিক নারীদের জীবনে আলো ফেরাতে এগিয়ে এসেছে সাজেদা ফাউন্ডেশন, তাদের প্রকল্প ‘সুদিন সত্তা’ নিয়ে।
এক সময় যারা সংসারের চার দেয়ালের বাইরে পা রাখেননি, সেই নারীরাই আজ আয় করছেন, সংসারের বোঝা বইছেন না, বরং ভাগ করে নিচ্ছেন। এখানে যে কেবল ঋষি পাড়ার মেয়েরাই আছেন তা নয়, আছেন স্থানীয় প্রান্তিক নারীরাও।
তাদের চোখে আজ নতুন আত্মবিশ্বাস, হাতে নতুন দক্ষতা, আর হৃদয়ে নতুন পরিচয়ের গর্ব—“আমি শিল্পী, আমি সত্তা।”
নারীর হাতের কাজে নতুন সম্ভাবনা
সত্তা প্রকল্প শুধু দক্ষতা উন্নয়ন নয়—এটি এক সমগ্র জীবন উন্নয়নের যাত্রা। এখানে নারীরা শেখেন— ব্লক প্রিন্ট, বাটিক, কারচুপি, ন্যাচারাল ডায়িং, হ্যান্ডপেইন্টিং ও টেইলারিং। আর হ্যান্ডএম্ব্রয়ডারি তো আছেই।
বাংলার ঐতিহ্যবাহী হস্তশিল্পে আধুনিক রঙের ছোঁয়া এনে তৈরি করছেন পোশাক, যা একাধারে স্টাইলিশ, টেকসই ও সংস্কৃতিনির্ভর।
কিন্তু এখানেই শেষ নয়—
প্রতিটি নারী পান টেলিহেলথ সেবা, মানসিক স্বাস্থ্য পরামর্শ, আত্মবিশ্বাস ও নেতৃত্ব বিকাশের প্রশিক্ষণ এবং ডিজিটাল দক্ষতা উন্নয়নের সুযোগ।
কারণ, সত্তার বিশ্বাস—একজন দক্ষ কারিগর তৈরি হয় কেবল হাতে নয়, মনে ও মননেও।
বাজারে প্রবেশ: সৃষ্টির মঞ্চে আত্মপ্রকাশ
বর্তমানে ৪ জন নারী উদ্যোক্তা এই প্রকল্পে কাজ করছেন, তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন একজন পেশাদার ফ্যাশন ডিজাইনারও। তাদের সুচিকর্ম করা পোশাক সম্প্রতি প্রদর্শিত হয়েছে ঢাকা ফ্লো ফেস্টের রানওয়েতে, যেখানে প্রতিটি পোশাক যেন বলেছে একেকজন নারীর মুক্তির গল্প। এই সাফল্য শুধু পোশাকের নয়, বরং এক সম্প্রদায়ের পুনর্জন্মের সাক্ষ্য। এ যেন এক অবাক অভিযান প্রান্তিক থেকে মূলস্রোতে উত্তরণের।
আর্কা ফ্যাশন উইকে
৫ ডিসেম্বর থেকে শুরু হয়েছে আর্কা ফ্যাশন উইক, যেখানে সত্তার নারীদের হাতে তৈরি পোশাক আবারও উঠেছে রানওয়ের আলোয়। ফ্যাশনিস্তারা রোশনাইয়ের নিচে মুগ্ধ হয়ে দেখেছেন প্রতিটি নকশার কারুকাজে জীবনের ছোঁয়া— কেউ কেউ হয়তো মনে মনে বলেছেন “এই পোশাক শুধু ডিজাইন নয়, নারী জীবনের পুনর্লিখন।”
কারণ শুধু ফ্যাশন উইকের র্যাম্পে প্রদর্শনের মধ্য দিয়ে থেমে থাকেনি এই প্রয়াস; বরং এসব পোশাক যাতে ভবিষ্যতে ঢাকার ফ্যাশনপ্রিয়রা পেতে পারেন সে ব্যবস্থাও ইতিমধ্যে নেওয়া হয়েছে।
শেষ কথা
সত্তা এখন শুধু একটি প্রকল্প নয়—এ এক নীরব আন্দোলন। একটি হাত যখন সুচে সুতো গেঁথে ফেলে, সে শুধু কাপড়ে নকশা তোলে না, নিজের ভবিষ্যৎও রচনা করে। রানওয়ের আলো হয়তো নিভে যাবে কোনো এক সময়, কিন্তু বেরাইদের ঋষিপাড়ায় এখন যে আলো জ্বলেছে—দেদীপ্যমান থাকবে। সেই প্রোজ্জ্বল আলোই তো সত্তা।