এভারেস্ট বেজক্যাম্প থেকে শাকিল বললেন, ‘চূড়ায় উঠে মনে হচ্ছিল কতক্ষণে নিচে নামব’

পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ এভারেস্ট জয় করে নিরাপদে বেজক্যাম্পে ফিরে এসেছেন বাংলাদেশি পর্বতারোহী ইকরামুল হাসান শাকিল। আজ নেপাল সময় সকাল সাড়ে ১১টায় তিনি ক্যাম্প–২ থেকে বেজক্যাম্পের নিরাপদ আশ্রয়ে পৌঁছান। তবে অতি উচ্চতা, প্রতিকূল আবহাওয়া আর দীর্ঘ অভিযানের ধকল তাঁকে বেশ কাহিল করে ফেলেছে।

আজ ২০ মে সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় বেজক্যাম্প থেকে হোয়াটসঅ্যাপে ইকরামুল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঠান্ডায় কথা বলতেও পারছি না। বাজে আবহাওয়ার মধ্যে সামিট (চূড়ায় আরোহণ) করেছি। চূড়ায় উঠে মনে হচ্ছিল কতক্ষণে আমি নিচে নামব। এত তুষারপাত আর বাতাস যে চারপাশটা সাদা হয়ে এল। কোনোমতে দু-তিনটা ছবি তুলেই নিচে নামতে শুরু করি।’

এভারেস্ট চূড়ার উদ্দেশ্যে বেজক্যাম্প থেকে গত ১৬ মে ক্যাম্প-২-এ যান ইকরামুল হাসান। ১৭ মে ক্যাম্প-৩ এবং ১৮ মে ক্যাম্প-৪-এ ওঠেন। এই ক্যাম্প থেকেই চূড়ান্ত যাত্রা করে ১৯ মে যাত্রা করে স্থানীয় সময় সকাল সাড়ে ছয়টায় এভারেস্ট চূড়ায় পৌঁছান।

সেই যাত্রার অভিজ্ঞতা সম্পর্কে ইকরামুল হাসান বলেন, ‘ক্যাম্প-৪ থেকে যাওয়ার সময়ই প্রচুর বাতাস আর তুষারপাতের মধ্যে পড়েছিলাম। বারবার মনে হচ্ছিল চূড়ায় পৌঁছাতে পারব তো। আশঙ্কা নিয়েই ধীরে ধীরে চূড়ার দিকে যাই। হিলারি স্টেপের (চূড়ার কাছাকাছি জায়গা) কাছে পর্বতারোহীদের ডেডবডি (মৃতদেহ) দেখলাম। এর মধ্যে সম্প্রতি মারা গেছেন এমন দেহও দেখেছি।’

এভারেস্ট শৃঙ্গ থেকে গতকালই ক্যাম্প-৪ হয়ে সন্ধ্যা নাগাদ নেমে আসেন ক্যাম্প-২ পর্যন্ত। রাতে বিশ্রাম নিয়ে আজ সকালে নামতে থাকেন বেজক্যাম্পের পথে। সকাল সাড়ে ১১টায় পৌঁছেও যান বেজক্যাম্পে।

আক্ষেপ করে ইকরামুল হাসান বলেন, ‘চূড়ায় গিয়ে ছবি তুলব, ভিডিও করব-কত পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু আবহাওয়া এতই প্রতিকূল ছিল যে বাঁধাই করে রাখব এমন মনের মতো একটা ছবিও তুলতে পারিনি।’

ইকরামুল হাসান তাঁর এই অভিযানের নাম দিয়েছে ‘সি টু সামিট’, অর্থাৎ সমুদ্র থেকে শৃঙ্গ। সেই লক্ষ্যেই গত ২৫ ফেব্রুয়ারি দুপুরে কক্সবাজারের ইনানী সমুদ্রসৈকত থেকে এভারেস্টচূড়ার উদ্দেশে হাঁটা শুরু করেন। চট্টগ্রাম, ফেনী, কুমিল্লা ও মুন্সিগঞ্জ হয়ে ১২ দিন পর ঢাকায় পৌঁছান। কয়েক দিন বিরতি দিয়ে আবার হাঁটা শুরু করে গাজীপুর, টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জ হয়ে ২৮ মার্চ পৌঁছান পঞ্চগড়ে। ইকরামুল হাসান পরদিন বাংলাদেশ থেকে প্রবেশ করেন ভারতে। সে দেশের জলপাইগুড়ি, দার্জিলিং হয়ে ৩১ মার্চ পা রাখেন নেপালে। এভাবে হিমালয়ের পাবত্যপথে হেঁটে গত ২৯ এপ্রিল এভারেস্ট বেজক্যাম্পে পৌঁছান ইকরামুল হাসান।

তার পর থেকে সেখানেই অবস্থান করছিলেন ইকরামুল হাসান। মাঝে ৬ মে রোটেশনে বের হন। একে একে ক্যাম্প-৩ পর্যন্ত পৌঁছে আবার বেজক্যাম্পে নেমে আসেন ১০ মে। এই পুরো রোটেশন এভারেস্ট অভিযানের মূল শৃঙ্গারোহণের প্রস্তুতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এরপর মূল অভিযানের জন্য বেজক্যাম্প ছাড়েন ১৬ মে।

‘সি টু সামিট’ অভিযানের সমন্বয়ক সাদিয়া সুলতানা গত মঙ্গলবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘ ইকরামুল হাসান শাকিল ৯০ দিনের মধ্যে এভারেস্টচূড়ায় আরোহণের লক্ষ্য নিয়ে অভিযান শুরু করেছিলেন। ৮৪তম দিনে তিনি এভারেস্ট শিখরে পৌঁছালেন। প্রায় ১৩৭২ কিলোমিটার পথ পায়ে হেঁটে এ অভিযান শেষ করলেন শাকিল।’

গাজীপুরের কালিয়াকৈরের তরুণ ইকরামুল হাসান সমুদ্র থেকে শৃঙ্গ ছোঁয়ার এই অভিযানের অনুপ্রেরণা পেয়েছেন অস্ট্রেলিয়ার পর্বতারোহী টিম ম্যাকার্টনি-স্নেপের কাছে। ১৯৯০ সালে তিনি দ্বিতীয়বারের মতো এভারেস্ট শৃঙ্গে আরোহণের পরিকল্পনা করেন। তাঁর একক অভিযানটির নাম দেন ‘সি টু সামিট এক্সপেডিশন’। অর্থাৎ সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে হেঁটে পৃথিবীর সর্বোচ্চ শৃঙ্গে পৌঁছানোর প্রয়াস। টিম করেছিলেনও তা-ই, ভারতের গঙ্গাসাগর থেকে ৯৬ দিনে ১ হাজার ২০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে পা রাখেন পৃথিবীর সর্বোচ্চ শৃঙ্গে। ৩৫ বছর আগের ম্যাকার্টনির সেই কৃতিত্বে অনুপ্রাণিত হয়ে বাংলাদেশের পর্বতারোহী ইকরামুল হাসানও তাঁর অভিযানের নাম দেন ‘সি টু সামিট’। দেশের জনপ্রিয় পর্যটনস্থান কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত থেকে ইকরামুল হাসান হেঁটে জয় করলেন এভারেস্ট শৃঙ্গ।

কাল ২১ মে এভারেস্ট বেজক্যাম্প থেকে নিচের থেকে নেমে আসবেন ইকরামুল হাসান।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *