২০১৪ সালে বন্ধুরা মিলে সাকা হাফং অভিযানে যাচ্ছি। হঠাৎই দলে এসে ভিড়লেন এক আগন্তুক। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে পড়েন, নাম বাবর আলী। টুকটাক ট্রেক করেন শুনে কেউ আর আপত্তি করিনি। আর অভিযান শেষে আগন্তুক বাবর হয়ে উঠলেন নিজেদের মানুষ। তাঁর চোখে অনেক স্বপ্ন। এই পাহাড়পাগল একদিন যে কিছু একটা করবেন, পথ চলতে চলতেই সেটা জানা হয়ে গেছে। কিন্তু সেই কিছুটা যে এভারেস্ট, লোৎসে, অন্নপূর্ণাশিখর ছোঁয়া, কে তা ভেবেছিল! চোখের সামনেই বাবর নামের এক বীজকে বৃক্ষে পরিণত হতে দেখলাম, লক্ষ্য স্থির করলে যাঁকে আর কিছুই নাড়াতে পারে না।
গহিন বন, সমুদ্রের উত্তাল জলরাশি থেকে বরফঢাকা শৃঙ্গ—সবখানেই বাবরের অবাধ বিচরণ। রক ক্লাইম্বিং, স্কুবা ডাইভিং, কায়াকিং, আলট্রা রানিং, সাইক্লিং, সাঁতার, ক্রস কান্ট্রি হাইকিং—অ্যাডভেঞ্চারের সব শাখাতেই বাবর আলীর সরব উপস্থিতি। সাইকেলে চেপে ভারতের কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী গেছেন, হেঁটেছেন শ্রীলঙ্কার এ-মাথা থেকে ও-মাথা, দেশের ৬৪ জেলা ৬৪ দিনে হাঁটার মতো কাজ করেছেন।
শুধু অ্যাডভেঞ্চারেই নয়, নানা কল্যাণমূলক কর্মকাণ্ডেও সমান তৎপর বাবর। যুক্ত আছেন পাহাড়ি শিশুদের মধ্যে শিক্ষার আলো ছড়ানোর সংগ্রামে। চিকিৎসাসেবা দিতে প্রায়ই ছুটে যান দুর্গম পাহাড়ি গ্রামে, যেখানে এক ফোঁটা ওষুধের জন্যও মানুষ অপেক্ষা করে মাসের পর মাস। আর পরিবেশের প্রতি তাঁর ভালোবাসা? বহুবার দেখেছি, পাহাড়ের পথে পড়ে থাকা প্রতিটি প্লাস্টিকের টুকরা তিনি কুড়িয়ে নিচ্ছেন যত্ন করে, যেন নিজের হাতে পরিষ্কার করছেন প্রকৃতির ক্ষত।
একজন বাবর আলী হতে আসলে কী লাগে? হয়তো অগাধ সাহস। হয়তো অফুরন্ত কৌতূহল। কিন্তু সবচেয়ে বেশি লাগে নিঃস্বার্থ ভালোবাসা। মানুষের প্রতি, প্রকৃতির প্রতি, জীবনের প্রতি। বাবরের অর্জন কোনো স্বপ্নে পাওয়া মহৌষধ নয়। বরং বছরের পর বছর ধরে চলা গভীর আত্মচর্চা, প্রকৃতির প্রতি অমোঘ ভালোবাসা ও নিরবচ্ছিন্ন সাধনার ফসল। এসব করতে গিয়ে তাঁকে চিকিৎসাসেবার মতো আকর্ষণীয় পেশা থেকে বিরতি নিতে হয়েছে, বিসর্জন দিতে হয়েছে অনেক শৌখিনতা।তাঁর অন্যতম বৈশিষ্ট্য সরলতা। নেপালের অচেনা কোনো পথচারী কিংবা দেশের প্রত্যন্ত গ্রামের কোনো বয়স্ক চা-ওয়ালা—সবাই ওর কাছে সম্মানের পাত্র। হাসিতে কোনো ভান নেই; কথায় নেই গর্বের ছায়া। চলনে মাখা মাটির গন্ধ। হাসিতে নদীর কলকল শব্দ। পাহাড়ের গায়ে জমে থাকা কুয়াশার মতোই চরিত্রে মিশে আছে কোমলতা। শক্ত হলেও নরম, দুর্জয় হলেও মানবিক। যেমন তিনি ছায়াঘেরা উপত্যকায় বা গ্রামের মেঠো পথে হাঁটতে ভালোবাসেন, তেমনি মানুষের সহজ–সরল কথায় ডুবে থাকতেও ভালোবাসেন।
বাবর আলী পড়ুয়া মানুষ। লম্বা ট্রেকের পর সবার ক্লান্ত দেহ যখন তাঁবুর কোণে পড়ে থাকে, বাবর তখন ঝোলা থেকে বই বের করেন। তিনি শুধু বই পড়েন না; বইয়ের ভেতর বাস করেন। পড়তে পড়তে কখন যেন লেখালেখিতে দক্ষ হয়ে উঠলেন। তাঁর কলমে যেমন ফুটে ওঠে হিমালয়ের হিমেল বর্ণনা, তেমনি উঠে আসে দরিদ্র গ্রামের করুণ চিত্র।
পাহাড়ের চেয়ে নিজেকে ক্ষুদ্র ভাবতে শিখে গেলে অহংকারের কোনো স্থান থাকে না। বাবর নিজেকে গড়েছেন মাটি থেকে, আবার মাটিতেই নিজেকে খুঁজে পান। তিনি পর্বতারোহণের গল্প লিখেছেন, আবার নিজের ভেতরেও দাঁড় করিয়েছেন এক বিশাল পর্বত—নিষ্ঠা, বিনয় আর ভালোবাসার পর্বত। বাবর স্বপ্ন দেখেন একদিন বিশ্বের ১৪টি ৮ হাজার মিটার শৃঙ্গের সব কটিতে লাল-সবুজের পতাকা ওড়াবেন। ইতিমধ্যে যার তিনটি অর্জিত হয়েছে। আমারও দৃঢ় বিশ্বাস, এমন নিমগ্ন পর্বতসাধককে প্রকৃতি নিরাশ করবে না।