ইটের খোয়া ভেঙে জীবন ধারণ


উন্নয়নশীল বাংলাদেশে অবকাঠামো নির্মাণে হতদরিদ্র নারীদের শ্রম বিনিয়োগ এক অপরিহার্য বিষয়। সম্প্রতি জয়পুরহাটের ইট ভাঙা নারীদের শ্রমের মজুরির ওপর এক চিত্র উঠে আসে।
নারী শ্রমিকের কর্মব্যস্ত জীবন বর্তমান সমাজের দৃশ্যমান এক বাস্তবতা। সেটা আজ গৃহকর্ম ছাড়িয়ে দালানকোঠা, সড়কের নির্মাণ কাজে লাগাতার শ্রম বিনিয়োগ, ন্যায্যতা পায়। সেখানেও দুঃসহ যন্ত্রণাদায়ক পরিস্থিতি সর্বক্ষণ তাড়িয়ে বেড়ায়। জয়পুরহাটের পাঁচবিবির ৭০ পরিবারের নারীরা এমন শক্ত ইট ভেঙে রোজগার করছেন। সেই শারীরিক কষ্টের অর্থে সংসারও চালাচ্ছেন বলে তথ্য-উপাত্তে উঠে আসছে। কিন্তু চিরায়ত দুর্ভোগও পিছু না ছাড়াও সময়ের নির্মমতা। কঠোর দৈহিক পরিশ্রম নিয়োজিত নারীরা আবার সংসার ধর্ম থেকেও বিচ্ছিন্ন থাকতে পারে না। কাক ডাকা ভোরে তাদের উঠতে হয়। পরিবারের সদস্যদের যাবতীয় দায়িত্ব সমাধা করে ছুটতে হয় শক্ত ইট ভাঙার কাজে। যা কোমলমতী নারীর শরীরের জন্য খুব একটা স্বস্তিদায়কও হয় না। নরম হাতে লোহার হাতুড়ি দিয়ে ইট ভাঙতে যাওয়ার আগে পারিবারিক আঙিনা ছোট গৃহকোণে সারতে হয় সাংসারিক যাবতীয় কাজকর্ম। এটা শুধু জয়পুরহাটের দৃশ্যই নয়, সারা বাংলাদেশে বিভিন্ন নির্মাণ কাজে হতদরিদ্র নারীদের অংশ নেওয়া আজ এক কঠিন রূঢ় বাস্তবতা। কিন্তু বিভিন্ন সময় প্রতিবাদ প্রতিরোধে আওয়াজ তোলা হয় সময়, কাজের ধরন মোটামুটি এক থাকা সত্ত্বেও বেতনে থাকে বৈষম্যের আচড়। কমপক্ষে ১০০ টাকা কম। পুরুষ শ্রমিক যদি ৫০০ টাকা পায় নারীরা পাচ্ছেন সেখানে ৩৫০ টাকা। আবার স্বামী বাবুটির কাছে পারিবারিক কিংবা সংসার ধর্মে তেমন কিছু করণীয় থাকে না। আবার সংসার মানে কিন্তু সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের কোনো চিহ্ন থাকে না। নিদেনপক্ষে মাথা গোঁজার ঠাঁই। সেখানে আবার ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর আদিবাসীরা সম্পৃক্ত থাকে। যাদের সাধারণত নুন আনতে পান্তা ফুরায়। এক সময় তাদের পেশা ছিল কুলিগিরি। রেল-বাস স্টেশনে যাত্রীদের মালামাল ট্রেনে ওঠানো-নামানোর কাজ করা। বর্তমানে বাংলাদেশে নগর, শহরায়ণের দ্রুত পরিবর্তন পেশা ক্ষেত্রেও এনেছে হরেক বৃত্তি। কৃষিতে যেমন নারী কৃষিজীবীরা শস্যখেতে তাদের শারীরিক শ্রম উজাড় করে দিচ্ছে। পাশাপাশি সংসার ধর্মেও পালন করে যাচ্ছে নিজেদের যথাযথ কর্তব্য ও দায়িত্ব সম্পাদন। শুধু কি কর্তব্য পালন? সর্বংসহা জননীকে কোনো এক সময় চিরায়ত মাতৃত্বের আবরণে নিজেকে ভরিয়ে তোলাও জগৎ সংসারই শুধু ভেতরের বোধেও থাকে এক অকৃত্রিম মায়া-মমতার বন্ধন জাল। সেখানে সন্তান গর্ভে ধারণ করেও নারী শ্রমিকের নিত্য কর্মযোগে বিরাম-বিরতি না থাকাও সমাজ-সংসারের আর এক অচ্ছেদ্যবাধন। মেনে নিয়ে সব কিছু সমাধা করাও শুধু নারী শ্রমিক কেন যে কোনো কর্মজীবী নারীর নিত্য কর্তব্য পালনের এক অপরিহার্য বিধি। নারীর গৃহশ্রমকে মূল্যায়ন কখনো করা হয় না। মাঝে মধ্যে প্রতিবাদ, বিক্ষোভ মাথা চাড়া দিলেও সমাজ কাঠামো মূলে জিইয়ে থাকা মান্ধাতা আমলের রীতি সংস্কারের বদল শ্রমজীবী নারীদের বেলায় অদৃশ্য এক বাতাবরণ। তার পরেও নীরবে নিঃশব্দে সংসার ধর্ম পালন করে পরিবারে সুখ-শান্তি বজায় রাখা নিত্যদিনের এক বিশেষ পর্যায়। তবে উন্নয়নের সুদৃশ্য অবকাঠামো দৃশ্যমান হলেও নারী শ্রমিকদের বঞ্চনার ইতিবৃত্ত আজও চিরায়ত এক অসহনীর জ্বালা-যন্ত্রণা। 
শেষ হয়েও যেন আরও ভিন্নমাত্রায় যন্ত্রণার পেশন সংশ্লিষ্টদের তাড়িয়ে বেড়ায়। সন্তান গর্ভে ধারণ করেও কোনো অবসান না পাওয়া আর এক নির্মমতার ক্ষতচিহ্ন। আবার সেই সব সাধারণ কর্মস্থলে নির্যাতন, নিপীড়নও হতে সময় লাগে না। নিম্ন বিত্তের শ্রমিক নারীদের দুরবস্থা আরও প্রকট এবং অসহনীয়। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের পরেও কোনো সমতার আদল দৃশ্যমান হতে না পারা আর এক বিভাজনের নগ্নতা। পুরানো নানামাত্রিক বিধি বিভাজন সমাজের গভীর শিকড় গেড়ে জিইয়ে থাকাও আধুনিকতার ভিন্নমাত্রার আবর্জনা। আজও তা উপড়ে ফেলা অসম্ভবের পর্যায়ে থেকে গেল। কবে যে বৈষম্য তার বন্ধন থেকে মুক্ত হবে সেও এক অজানা অপরিচিত জগৎ।
আর কঠিন ইট ভাঙার পরিশ্রমে যারা নিযুক্ত হন তারা সিংহভাগই বিধবা কিংবা স্বামী পরিত্যক্তা। যাদের আয়-রোজগারের আর কোনো সম্বল কিংবা রাস্তা থাকে না। অনেকটা ছিন্নমূল পথহারা অসহায় মানুষের মতো। দুঃখ-কষ্টও ভাগ করার মতো কেউ থাকেই না। নির্বিত্ত, গৃহহীন, কর্মহীন নারীরাই এমন সব কাজে নিযুক্ত থাকে। যেসব কর্মে আসলে কোনো ধারাবাহিকতাই নেই। জীবনের স্বচ্ছন্দ গতিও পদে পদে ব্যাহত। নির্মাণ কাজ শেষ হলে আর অন্য কিছু করাও যেন এক জগদ্দল পাথর। মেনে-মানিয়ে চলা সত্যিই পথে পথে কাঁটা বিছানো পাথর ছড়ানোর মতো পিচ্ছিল রক্তাক্ত পথ। সন্তান জন্মের পরও কোনো বিশ্রাম-বিরতি থাকে না। অসুস্থ অবস্থায়ও কাজে যোগ দিতে হয়। সদ্যজাত শিশু সন্তানটিকে বুকের দুধ খাওয়াতেও হিমশিম অবস্থায় পড়ে যাওয়া। তার ওপর অন্য বিপত্তি। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পাওয়া তো আছেই। ইটের মূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে অথচ নারী শ্রমিকদের মজুরিও দিন দিন কমে যাচ্ছে বলে আপত্তি উঠেছে। 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *