
‘মহেশখালী সমন্বিত উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ-মিডা’ সংক্রান্ত অধ্যাদেশটি ২৩ জুলাই গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়।
কক্সবাজারের মহেশখালী দ্বীপকে শিল্প ও বাণিজ্যিক অঞ্চলে রূপান্তরের লক্ষ্যে সরকার পরিকল্পনা সংক্রান্ত অধ্যাদেশ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছে দ্বীপবাসী।
‘মহেশখালী সমন্বিত উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ-মিডা’ সংক্রান্ত অধ্যাদেশটি ২৩ জুলাই গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়। এর পর থেকেই দ্বীপের সাধারণ মানুষ এ নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া জানান।
সোমবার সকালে এই অধ্যাদেশ বাতিলের দাবিতে কক্সবাজার শহরে এসে গণসমাবেশ করেছে মহেশখালী রক্ষা আন্দোলন নামের একটি সংগঠন।
সংগঠনটি মনে করছে, মিডা বাস্তবায়িত হলে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সামাজিক সম্প্রীতি, সামাজিক ও মানবিক মর্যাদা, পরিবেশগত স্থায়িত্বশীলতা, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা, নিরাপদ জীবনব্যবস্থা, স্থানীয় জনগোষ্ঠীর ভূমির অধিকার এবং অনাগত প্রজন্মের নিরাপদ ভবিষ্যতের উপর গভীর আঘাত আসবে।
মিডা সম্পর্কে মহেশখালীর মানুষের কোনো মতামত নেওয়া হয়নি জানিয়ে কলেজ শিক্ষক মকবুল আহমেদ বলেন, “মিডা নামের যে অধ্যাদেশ সরকার জারি করেছে সেটি সম্পর্কে মহেশখালীর মানুষ কিছুই জানে না। উন্নয়ন করবেন কিন্তু তার ফলে স্থানীয় জনগণের কেমন লাভ বা ক্ষতি হবে সেটি বিবেচনা করা হয়েছে কিনা বা সেটি সম্পর্কে স্থানীয় জনগণের মতামত নেওয়া হয়েছে কিনা সেটিই বড় প্রশ্ন। আমরা অবিলম্বে এই মিডা প্রকল্প বাতিল চাই।”
পরিবেশবাদী সংগঠন সিএইচআরডিএফ এর প্রধান নির্বাহী ইলিয়াছ মিয়া বলেন, “মিডা প্রকল্পের নীল-নকশা তৈরি করেছে বিগত ফ্যাসিস্ট সরকার। যেটি বাস্তবায়ন করছে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। গণঅভ্যুত্থানের মধ্যদিয়ে ক্ষমতায় আসা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারও জনগণের চাহিদা ও আকাঙ্খা পূরণে ব্যর্থ হচ্ছে। যেটির অন্যতম উদাহরণ হচ্ছে মিডা।”
মহেশখালী রক্ষা আন্দোলনের সংগঠক আব্দুল মান্নান রানা বলেন, “মহেশখালী শুধু একটি দ্বীপ নয়, এটি বাংলাদেশের অন্যতম প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ অঞ্চল। কৃষি, মৎস্য, লবণ ও পানচাষের উপর নির্ভর করে এখানকার প্রায় পাঁচ লাখ মানুষের জীবন ও জীবিকা। সরকারের মিডা প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে এই ঐতিহ্যবাহী ও প্রাকৃতিক জীবনব্যবস্থার উপর এক ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে আসবে। এ প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে প্রায় তিন লাখ মানুষ উদ্বাস্তু হব।”
মহেশখালীর বড় মহেশখালী ইউনিয়নের বাসিন্দা রুহুল আমিন বলেন, “মিডা প্রকল্পের বাস্তবায়ন মানে মহেশখালীতে দেশি-বিদেশি করপোরেটদের দখলদারিত্বের সুযোগ সৃষ্টি করা। এতে বাস্তুচ্যুত হবে হাজারো পরিবার, হারাবে নিজেদের ভূমি ও পরিচয়। উন্নয়নের নামে উপকৃত হবে কেবল কিছু ক্ষমতাধর ব্যক্তি ও করপোরেট গোষ্ঠী। না কৃষক, না জেলে, না সাধারণ মানুষের কিছু হবে। এই শোষণের রূপ অতীতেও আমরা ব্রিটিশদের সময় দেখেছি।”
সংগঠক আবদু রশিদ মানিক বলেন, “এরই মধ্যে মাতারবাড়ি কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্প, গভীর সমুদ্র বন্দর, এসপিএম, এলএনজি ও অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রকল্পের কারণে মহেশখালীর প্রাণ-প্রকৃতি ক্ষতিগ্রস্ত। এখন মিডার নামে মহেশখালীকে ধ্বংসের পরিকল্পনা করছে সরকার। মহেশখালী সমন্বিত উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নামে মহেশখালীর মানুষকে ভূমির অধিকার থেকে বঞ্চিত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। মহেশখালীর বাপ-দাদার কবরস্থানসহ সবগুলো সম্পত্তি মিডা প্রকল্পের নামে বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে। আমরা এটা বাতিলের দাবি জানাচ্ছি।”
মহেশখালী উপকূলীয় অঞ্চলকে শিল্প ও বাণিজ্যের অন্যতম কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে এবং মহেশখালী ও মাতারবাড়িতে চলমান মেগা উন্নয়ন প্রকল্পগুলো সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ‘মহেশখালী সমন্বিত উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ-মিডা গঠন করেছে সরকার। ২৩ জুলাই বুধবার সরকারি গেজেটের মাধ্যমে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব স্বাক্ষরিত এক প্রজ্ঞাপনে এ সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হয়।
এর আগে ১০ জুলাই মহেশখালী সমন্বিত উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ অধ্যাদেশ, ২০২৫ এর খসড়ার নীতিগত ও চূড়ান্ত অনুমোদন দেয় উপদেষ্টা পরিষদ।
তারও আগে গত বছরের ১৭ এপ্রিল তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক মন্ত্রিসভার বৈঠকে ‘মহেশখালী সমন্বিত উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ আইন, ২০২৪’ এর খসড়া অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল। কক্সবাজারের মহেশখালী ও মাতারবাড়ী এলাকায় চলমান উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর কাজ সমন্বিতভাবে করার জন্য এই কর্তৃপক্ষ করার সিদ্ধান্তের কথা বলেছিলো শেখ হাসিনার মন্ত্রিসভা।
তবে ২৯ জুলাই শেখ হাসিনার মন্ত্রিসভা এর নাম পাল্টে ‘মহেশখালী-কুতুবদিয়া সমন্বিত উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ’ নামে মহেশখালী সমন্বিত উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ আইনের চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছিল।
নতুন প্রকাশিত গেজেট অনুযায়ী, এই কর্তৃপক্ষ মহেশখালী এলাকায় সমন্বিত উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত হবে। পরিকল্পিত শিল্প স্থাপন, বিদ্যুৎ, পরিবহন, ভূমি ব্যবস্থাপনা ও সংশ্লিষ্ট অবকাঠামো উন্নয়নের উদ্দেশ্যে এ কর্তৃপক্ষ কাজ করবে। এতে বলা হয়, কর্তৃপক্ষের প্রধান কার্যালয় মহেশখালীতে থাকবে এবং এটি একটি বোর্ডের মাধ্যমে পরিচালিত হবে।
বোর্ডে পরিকল্পনা, বিদ্যুৎ, ভূমি, পরিবেশ, অর্থ, শিল্প, স্থানীয় সরকারসহ ১১টি মন্ত্রণালয় ও সংস্থার প্রতিনিধিরা থাকবেন। প্রধান উপদেষ্টা/প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিব বা সমমানের কর্মকর্তা বোর্ডের সভাপতির দায়িত্ব পালন করবেন।
প্রেক্ষাপট বিবেচনায় গভীর সমুদ্রবন্দর, বিদ্যুৎকেন্দ্র, শিল্প এলাকা ও অবকাঠামো নির্মাণসহ একাধিক বড় প্রকল্প বর্তমানে মহেশখালীতে বাস্তবায়নাধীন রয়েছে। এসব উন্নয়ন কর্মকাণ্ডকে সুসমন্বিতভাবে পরিচালনা করতেই এই কর্তৃপক্ষ গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
কর্তৃপক্ষের প্রধান দায়িত্বের মধ্যে থাকবে- শিল্প ও অবকাঠামো উন্নয়ন, পরিবেশ রক্ষা ও পরিকল্পিত নগরায়ণ, জমি অধিগ্রহণ ও পুনর্বাসন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের পরিকল্পনা, সড়ক ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন।