ফ্রান্সের ল্যুভর জাদুঘরে চুরির এক মাস পার হয়েছে। এই সময়ে ফরাসি কর্তৃপক্ষ একটি শিল্পকর্মও উদ্ধার করতে পারেনি। তবে এ ঘটনার পর থেকে আলোচনা চলছে সম্রাজ্ঞী ইউজেনির মুকুট ঘিরে। কারণ, ওই দিন চোরদের হাত থেকে পড়ে গিয়ে রক্ষা পেয়েছিল এই রাজমুকুট। পরে মুকুটটি ল্যুভরের কাছাকাছি রাস্তা থেকে উদ্ধার করে জাদুঘর কর্তৃপক্ষ।
ফ্রান্সের শেষ সম্রাটের স্মৃতি এই মুকুট। এটি বহু শতাব্দী ধরে ফরাসি রাজকীয় গহনার কেন্দ্রীয় আকর্ষণ ছিল। এর মূল্য কেবল হীরা আর পান্নার নিক্তিতে মাপা যায় না। এর প্রকৃত মূল্য ঐতিহাসিক ও শৈল্পিক মর্যাদায়।
চলুন, একবার দেখে নিই ঠিক কী ঘটেছিল গত ১৯ অক্টোবর। সকাল ৯টা ৩০। ল্যুভরের বিশাল ফটক মাত্র খুলেছে। পর্যটকের ভিড় বাড়ছে। হঠাৎ নিস্তব্ধতা ভাঙল এক যান্ত্রিক শব্দ। একটি লিফট নিয়ে চার মুখোশধারী হাজির। সেন নদীর পাশের বারান্দা দিয়ে উঠে গেল ওপরে। দুজন মুখোশধারী ভেতরে। শুরু হলো দর্শকদের ছোটাছুটি। কাচের ডিসপ্লে কেস ভেঙে ফেলে ওরা। হীরা-পান্না তুলে নেয়। অ্যালার্ম বেজে ওঠে। বাইরে অপেক্ষায় দুটি স্কুটার। মুহূর্তে চোরের দল উধাও। পালানোর সময় তাড়াহুড়া করতে গিয়ে একটি অলংকার চোরদের হাত থেকে পড়ে যায়।
৮ মিনিটে আটটি অলংকার নিয়েছিল চোরের দল। এর মধ্যে হাত থেকে পড়ে যাওয়াটি বাদে বাকি সাতটি এখনও খুঁজছেন ৬০ জন গোয়েন্দা। খোয়ানো অলংকারগুলোর দাম অন্তত ১০ কোটি ডলার। এরই মধ্যে এই ঘটনা নিয়ে প্রামাণ্যচিত্র বানানোর ঘোষণা দিয়েছেন ফরাসি-মার্কিন চলচ্চিত্র পরিচালক লরেন্ট বুজেরো।
উদ্ধার হওয়া মুকুটটি নতুন করে রহস্যের জন্ম দিয়েছে। ফরাসি কর্তৃপক্ষ যখন মুকুটটি খুঁজে পায়, তখন এটি কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত অবস্থায় ছিল। সম্ভবত হাত থেকে পড়ে যাওয়ায় মুকুটটির কিছু অংশ ভেঙেছে।
ঐতিহাসিক ও অলংকার বিশেষজ্ঞরা জানান, এই মুকুটটি তৈরি হয়েছিল ১৮৫৫ সালে। তখন সম্রাট ছিলেন তৃতীয় নেপোলিয়ন। ওই বছর তিনি স্ত্রী ইউজেনি দে মন্টিজোকে ফ্রান্সের সম্রাজ্ঞী হিসেবে ঘোষণা করেন। এ জন্য রীতি অনুযায়ী মুকুট পরান। সম্রাজ্ঞী ইউজেনি ছিলেন সেই সময়ের ইউরোপের অন্যতম ফ্যাশন আইকন। তাঁর জন্ম ১৮২৬ সালে স্পেনের গ্রানাডায় অভিজাত পরিবারে। তাঁর পোশাক, গহনা এবং জীবনযাত্রা সমগ্র ইউরোপে অনুকরণ করা হতো। সম্রাট যখন দেশের বাইরে থাকতেন, তখন সম্রাজ্ঞী দেশ শাসন করতেন। এই মুকুটের নকশা ও নির্মাণ প্রক্রিয়া তদারকি করেছিলেন ইউজেনি। মুকুটটি ছিল তৎকালীন ফরাসি রাজতন্ত্রের ঐশ্বর্য, ক্ষমতা এবং আভিজাত্যের বহিঃপ্রকাশ। এতে দুই হাজার ৪৯৪টি হীরা এবং ৫৬টি পান্না বসানো ছিল। এতে সূর্যের আলো পড়লে দ্যুতি ছড়াত।
১৮৭০ সালে তৃতীয় নেপোলিয়নের পতন ঘটে। ফ্রান্সের রাজতন্ত্র যুগের সমাপ্তি হয়। নতুন রিপাবলিক সরকার রাজকীয় ক্ষমতা এবং বিলাসিতার প্রতীক এই মুকুটটিকে ধ্বংস না করে এটিকে জাতীয় সম্পদ হিসেবে ঘোষণা করে। এই মুকুট এবং অন্যান্য রাজকীয় গহনা পরে প্যারিসের ঐতিহাসিক ল্যুভর জাদুঘরে স্থান পায়। এটি এখন ফরাসি ঐতিহ্য ও ইতিহাসের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। এটি নিছক গহনা না, বরং সময়ের প্রতীক।
সম্রাজ্ঞী ইউজেনির মুকুটটি আবারও তার আসল জায়গায় ফিরে আসবে। তবে এই ঘটনা প্যারিস কর্তৃপক্ষকে জাদুঘরের দুর্বল নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী করতে বাধ্য করেছে। এর অংশ হিসেবে প্রায় ৯০ কোটি ডলার ব্যয় করা হচ্ছে। ল্যুভরে মিউজিয়ামের পরিচালক লরেন্স দে
কার্স বলেন, প্রায় ১০০ নতুন নজরদারি ক্যামেরা এবং অনুপ্রবেশবিরোধী ব্যবস্থা স্থাপন করা হবে।