মায়ের বাড়ি ফেরা

বাদশার কথা বলছি। সে যখন তোমাদের মতো ছোট্টমোট্ট তখন তাকে আর তার ছোট বোনকে নানির কাছে রেখে মা চলে এসেছিলেন শহরে। অভাবের সংসার তাদের। খাওয়া পরা চলছে না। কাজ করতে হবে। যে কাজই পাওয়া যায়; দোকানে অথবা কারও বাড়িতে।
মায়ের জন্যে খুব মন খারাপ হয়। নদীর ধারে পুকুর পাড়ে গাছের নিচে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে সে তার মন খারাপের সময়টা কাটায়। মাঝে মাঝে মাকে ভেবে কান্না আসে। নীরবে চোখ মোছে। আড়াল থেকে নানি দেখে ফেললে সে বলে, মায়ের জন্যে মন খারাপ লাগে। 
নানি খুব আদর করেন ছোট্ট বাদশাকে। কিন্তু তারা পথ চেয়ে থাকে মা কবে আসবে। কবে তার ছুটি হবে। বাবা সারাদিন ভ্যান গাড়িতে করে সবজি বিক্রি করেন। তাতে যা আয় হয় তা দিয়ে সংসার চলে না। নানি বুড়ো মানুষ। কাজ করতে পারে না। দুটো নাতি নাতনিকে নিয়ে বাড়িতেই তার দিন কাটে।
এভাবে এক সময় বাদশার ইচ্ছে হলো মায়ের সঙ্গে বেড়াতে যাবে শহরে। সামনে ঈদ।
ঈদে বাড়ি এলেন মা। ছুটি কাটিয়ে শহরের কাজে ফিরে যাবার সময় হলো। যাবার সময় বাদশা কিছুতেই মাকে একা যেতে দেবে না। মা অনেক বুঝিয়ে বললো, ‘কই রাখমু তোমারে? ওইখানে ছুট্টু একটা ঘরে আমরা কয়েকজন থাহি। ঘরের এক কোনায় একটা বিছানার জাগা শুধু আমি ভাড়া করছি। তার নাম সিট ভাড়া। ওইখানে তোমারে তো রাখনের জাগা নাই বাপ। বিয়ান থাইকা বিকাল পর্যন্ত এক বাড়িত কাম করি। আমি বেতন পাইয়া তোমার লাইগা অনেক কিছু নিয়া আসমু। তুমি নানি আর বইনেরে লইয়া থাহো।’ 
বাদশা বলে, ‘না, আমি তোমার ওই সিটের মইদ্যেই থাকমু মা। তোমার লগে থাকমু। আমার এইডুক জাগা অইলেই অইবো।’ 
হাত দিয়ে ছোট্ট একটু জায়গা সে দেখায় মাকে। মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। আবার বলে, ‘মা, আমি না, গুমাইলে লড়াচড়া করি না। যেমনে রাখবা এমনেই থাকমু।’
আর না বলতে পারলেন না মা। শহরে নিয়ে এলেন ছেলেকে সাথে করে।
কয়েক দিন বেড়ানোর পর আবার বাড়ি পাঠিয়ে দিলেন। একা একা ঘরে সারাদিনের জন্যে রেখে যেতে ভয় লাগে। শহরে নতুন এসেছে। কিছু চেনা নেই। কোথায় কি হয় ঠিক নেই। তার বাবা এসে নিয়ে গেলো। বাড়ি গিয়ে তার অদ্ভুত এক পরিবর্তন হলো। সে বাজারে, দোকানে, বিভিন্ন মানুষের কাছে কাজ খুঁজে বেড়ায়। বাজারে গিয়ে মানুষের ব্যাগ, ছোট ছোট বোঝা টেনে আস্তে আস্তে সে আয় করতে শিখলো। এভাবে দু’বছর কেটে গেলো। 
একটু বড় হয়েছে বাদশা। তার মাকে আনতে গেলো শহরে। গিয়ে বলে, কিছুতেই মাকে কাজ করতে দেবে না। ‘তুমি বাড়িত লও মা। তোমারে আমি কাম করতে দিমু না। তুমি আইয়া দেখো আমি কতো কাম করতে শিকছি। আমি আয় করতে শিকছি। অহন থাইকা আমি কাম করমু তুমি বাড়িতে থাকবা। তোমারে আর কষ্ট করতে দিমু না।’
মা বললেন, ‘আর কয়ডা দিন কাম করি বাজান। আমাগো আরেকটু অবস্থা ভালো হউক।’ 
: না না মা। ভালা-মন্দ যাই অয় আমরা একলগেই থাকমু। 
মা তার ছেলেটার দিকে তাকিয়ে আছেন। ছোট্ট ছেলেটা এখনই দায়িত্ব নিতে চাচ্ছে। মাকে কষ্ট করতে দেবে না। বুক ভরে গেলো আনন্দে। কিন্তু চোখ ভরে গেলো পানিতে। এটা আনন্দের কান্না।
ছেলেকে বললেন, ‘বাজান, যে বাড়িতে কাম করি উনারে তো কইয়া যাইতে হইবো। ওনার অনেক কষ্ট। তার পোলাপান বিদেশে থাহে। টেকা পাডায়। কেউ দুই তিন বছরেও আয়ে না মায়েরে দেকতে। তারা নাকি অনেক ব্যস্ত। সারাদিন একলা একলা বুড়া মানুষটা থাহে। আমি কাম করি। আর একটা নার্স আছে। সইন্ধ্যার দিগে আইয়ে। সারাদিন উনি খালি ছেলেমেয়ের কতা গপ্প করে। মানুষটা বড় একলারে। ফালাইয়া থুইয়া যাইতে মায়া লাগে।’
কিছুক্ষণ দুজনেই চুপ। তারপর বাদশা বলে, ‘আমাগো থাইকা বেশি লাগে?’
মা অবাক হয়ে দুঃখ আনন্দ মেশানো চোখে ছেলের দিকে তাকিয়ে থাকে। মনে মনে ভাবে, এতো বড় অইয়া গেলো কবে ছুট্টু ছেলেডা?
‘মা, তুমি তো সারাজীবন উনার লগে থাকবা না। তুমি ভালা কইরা বুজায়া বইলা কইয়া বিদায় নিয়া আইবা। আমাগো কষ্ট অয় কইবা।’
: উনারো তো কষ্ট অয় বাবা।
: বুজছি। হেগো খালি একলগে না থাকনের কষ্ট। আর আমাগো অনেক অনেক কষ্ট। একলগে থাকলে একটা কষ্ট তো কমবো।
মা কোনো যুক্তি দিয়ে ছেলেকে বোঝাতে পারলো না।
অবশেষে বাদশা সত্যি সত্যি মাকে নিয়ে এলো গ্রামে। 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *