অর্ণব মাঝেমধ্যে হারিয়ে যান; দেখা মেলে না, জানার সুযোগ হয় না কখন কোথায় আছেন। ঠিক তাঁর গানের মতো; যেখানে তিনি বলেছেন, ‘হারিয়ে গিয়েছি, এটাই জরুরি খবর…’। এই হারিয়ে যাওয়ার কোনো সময় বেঁধে দেওয়া নেই। তাই দেখাও মেলে আচমকা। এমনই হঠাৎ দেখার কোনো কোনো মুহূর্তে সুখবরও শোনান তিনি। এই যেমন কখনও বলেন, ‘একটি অ্যালবাম করছি, মনে হয় কিছুদিনের মধ্যে সবার কাছে পৌঁছে দিতে পারব।’ গত বছরও এমন একটি সুখবর শোনা গিয়েছিল অর্ণবের মুখে। বলেছিলেন, ‘এবার কিছু কবিতা নিয়ে গান করছি, দেখি কী হয়।’ ব্যস, এটুকুই কথা। এরপর অ্যালবাম নিয়ে টুঁ শব্দটি করেননি। তবু আমরা খুশি হয়েছিলাম এই ভেবে যে, বহু বছর পর যখন অ্যালবামের কথা বলছেন, তাহলে নিশ্চয় অভিনব কিছু শ্রোতাকে উপহার দেবেন। ওই যে অ্যালবাম নিয়ে ওইটুকু বলা, তারপর কেবল ‘কোক স্টুডিও বাংলা’র কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকতে দেখা গেছে তাঁকে। এই সংগীতায়োজনে একের পর এক বিভিন্ন শিল্পীর গাওয়া ফিউশনধর্মী গানগুলো দেশজুড়ে আলোড়ন তুলেছে। এমনকি দেশের বাইরের দর্শক-শ্রোতারও মনোযোগ কেড়েছে। সেই সুবাদে গানের শিল্পী ও মিউজিশিয়ানদের পাশাপাশি ‘কোক স্টুডিও বাংলা’র সংগীত কিউরেটর হিসেবে প্রশংসা কুড়িয়েছেন অর্ণব নিজেও। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে শিকড়ের গানগুলোর সঙ্গে বিশ্বসংগীতের মিশেল ঘটানোর অভিনব এই আয়োজনের পরিকল্পনা নিয়ে অর্ণবের কথা ছিল এটাই–‘‘যে গানের কথা ও সুরে এ দেশের মানুষের মাটিঘেঁষা জীবন, প্রকৃতির নির্যাস, আধ্যাত্মিকতা, জীবনরহস্য থেকে শুরু করে নানা বিষয় মিশে আছে, তার অমোঘ আকর্ষণ থেকে দূরে সরে যাওয়া কঠিন। তাই ফিউশনধর্মী আয়োজন করতে গিয়ে শিকড়ের টান যেমন অনুভব করেছি, তেমনি নিরীক্ষার নেশাও পেয়ে বসেছে। তাই ‘কোক স্টুডিও বাংলা’র আয়োজনে দুটি বিষয়কেই প্রাধান্য দিয়েছি।’’ তাঁর এই কথা থেকে স্পষ্ট যে, অভিনব যা কিছুই করুন, নিজেকে শিকড় থেকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা কখনও করেননি। যে কারণে তাঁর নির্দেশনায় ‘কোক স্টুডিও বাংলা’র পরিবেশিত গানগুলো সহজেই দর্শক-শ্রোতা মনে কড়া নাড়তে পেরেছে। অর্ণব তাই প্রতিনিয়ত আরও ভিন্নধর্মী কিছু তুলে ধরার প্রয়াসে উঠেপড়ে লেগেছেন। তা করতে গিয়েই তাঁর একক অ্যালবাম প্রসঙ্গ আড়ালেই রয়ে গেছে।
অ্যালবামবিহীন বছর সংখ্যা ৯ থেকে ১০ হলো। অথচ তাঁর কোনো অ্যালবামের জন্য এতটা সময় শ্রোতাকে অপেক্ষায় থাকতে হয়নি। যদিও একক গানের জোয়ার শুরুর পর অনেকে অ্যালবাম প্রকাশনা থেকে সরে এসেছেন, কিন্তু অর্ণবকে কেউ সেইসব শিল্পী ও সংগীতায়োজকের দলে রাখেননি। ২০০৫ সালে প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান এক তার থেকে প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর প্রথম একক অ্যালবাম ‘চাইনা ভাবিস’। অভিনব এ আয়োজন সংগীতপ্রেমীর মাঝে দারুণ সাড়া ফেলেছিল। কারণ একটাই, এই অ্যালবামের মধ্য দিয়ে অর্ণব বাংলা গানের সংগীতায়োজনে নতুন শব্দ সংযোজন করেছিলেন। তাঁর গায়কি অন্য সবার চেয়ে আলাদা বলে মনে হয়েছিল শ্রোতার কাছে। এরপর একে একে প্রকাশিত ‘হোক কলরব’ (২০০৬), ‘ডুব’ (২০০৮), ‘রোদ বলেছে হবে’ (২০১০), ‘আধেক ঘুমে’ (২০১২) ও ‘খুব ডুব’ (২০১৫) নামে একক অ্যালবামের গানগুলো অর্ণবকে তুলে এনেছিল প্রথম সারির শিল্পীদের কাতারে। শুধু একক অ্যালবাম নয়, তাঁর সাবেক ব্যান্ড বাংলা দুটি অ্যালবাম ‘কিংকর্তব্যবিমূঢ়’ ও ‘প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব’ দারুণ সাড়া ফেলেছিল গানের ভুবনে। এ ছাড়াও নতুন ও পুরোনো গানের সংকলন ‘অন্ধ শহর’ এবং ‘অর্ণব অ্যান্ড ফ্রেন্ডস’র দুটি অ্যালবাম প্রকাশ করে ভক্ত-অনুরাগীদের প্রত্যাশা পূরণের চেষ্টা করেছেন অর্ণব। এর বাইরেও বিভিন্ন মিক্সড অ্যালবাম, নাটক ও চলচ্চিত্রে গান গেয়ে জয় করেছেন অগণিত শ্রোতাহৃদয়। অথচ এই শিল্পী ও সংগীত পরিচালকের ভক্তরা ‘অ্যালবাম’ শব্দটা প্রায় ভুলতে বসেছিলেন। এই যখন বাস্তবতা, তখনও সামাজিক মাধ্যমে দেখা গেল কয়েকটি ছবি। যেখানে দেখা গেল, একটি অ্যালবামের কাভার হাতে দাঁড়িয়ে ও বসে পোজ দিয়েছেন অর্ণব। দ্বিতীয় ছবিটি কাভার, যার শিরোনাম ‘ভাল্লাগেনা’। ক্যাপশনে লেখা, ‘‘আসছে আমার নতুন অ্যালবাম ‘ভাল্লাগেনা’…অপেক্ষা এই ৩০ তারিখের।’’ ব্যস, এতেই যা বোঝার বুঝে নিলেন সংগীতপ্রেমীরা, শুরু করলেন দিন গণনা। এরপর এলো ৩০ অক্টোবর। সংগীতপ্রেমীরা আবার নতুনভাবে আবিষ্কার করলেন শায়ান চৌধুরী অর্ণবকে। ‘ভাল্লাগেনা’ অ্যালবামের গানগুলো হৃদয় স্পর্শ করতে শুরু করল শ্রোতার। এটিই হলো ১০ বছর পর অর্ণবের অ্যালবাম প্রকাশের সংক্ষিপ্ত গল্প। তবে গল্পের আগে ও পরের আরও কিছু ঘটনা আছে, যেমন শিরোনাম গান প্রসঙ্গে অর্ণব জানান, বন্ধু গীতিকার রাজীব আশরাফ মারা যাওয়ার আগে তাঁর স্ত্রী শিল্পী সুনিধি নায়েকের কাছে ‘ভাল্লাগেনা’ কবিতাটি পাঠিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘কবিতাটা তুমি আর অর্ণব গেয়ো।’ এটি ছিল রাজীবের ‘ধরেছি রহস্যাবৃত মহাকাল’ কাব্যগ্রন্থের একটি কবিতা। এতে সুর বসাতে তিনি সময় নেননি। রাজীব সেই সুর পছন্দও করেছেন। তাঁর ইচ্ছা পূরণে সুনিধিকে নিয়ে গানটি গাইলেও এর প্রকাশনা দেখে যাওয়া ভাগ্য হলো না। তাই প্রয়াত বন্ধু ও গীতিকার রাজীব আশরাফকে অ্যালবামটি উৎসর্গ করা হয়েছে।
অ্যালবাম নিয়ে আরও অনেক কিছুই বলা যায়, তার চেয়ে বেশি বলা যায় অর্ণবকে নিয়ে। বলা শুরু করলে তা মহাকাব্যে রূপ নিতে পারে। শুধু এটুকু বলা যায়, অর্ণব স্বাধীনচেতা। যখন যা মন চায়, সেটিই করেন। যখন কিছুই করেন না; নিজের মাঝে নিজে বসবাস করতে চান, ছুটে যান প্রকৃতির কাছে। প্রকৃতির কোলে মাথা পেতে দিতে কাটিয়ে দেন যতটা সময় মন চায়। ওই যে তাঁর দুটি একক অ্যালবাম আছে না, যার শিরোনাম ‘ডুব’ ও ‘খুব ডুব’–ঠিক তেমনই স্বভাব নন্দিত এই শিল্পী ও সংগীতায়োজকের। কখনও দর্শক-শ্রোতার ভিড়ে গানে গানে উল্লাস, কখনও লোকচক্ষুর আড়াল হতে দেন ডুব। হয়তো সে কারণে সংগীত আর চিত্রকলায় দারুণ পারদর্শী এই শিল্পীকে আমরা কখনও যশ-খ্যাতির মোহে ছুটে বেড়াতে দেখি না। তিনি তাঁর গানের মতোন, যিনি নির্দ্বিধায় বলতে পারেন, ‘তুই গান গা ইচ্ছে মতোন, বাতাসকে খুশি করে বাঁচ…।’