ডিমেনশিয়া:একটি নীরব বৈশ্বিক সংকট

আরতি দেবী একজন প্রাণবন্ত হসিখুশি মা। এক সময় তিনি ছিলেন এক বৃহৎ পরিবারের কেন্দ্রবিন্দু। তাঁর বুদ্ধিমত্তা, স্নেহ আর যত্নে পরিবারটি ছিল সাজানো–গোছানো এক আশ্রয়। সংসারের প্রতিটি মানুষ, প্রতিটি প্রয়োজন তিনি নিখুঁতভাবে সামলাতেন। কিন্তু একসময় সব বদলে গেল। বয়সের ভারে তিনি আক্রান্ত হলেন ডিমেনশিয়া নামক এক নীরব অথচ নির্মম রোগে। ধীরে ধীরে তাঁর স্মৃতি ঝাপসা হতে শুরু করলো। নিত্যনৈমিত্তিক অনেক কিছই ভুলে যেতে লাগলেন। কখনও কখনও একা বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়েন, আবার ঘরে ফেরার পথও খুঁজে পান না। তাঁর সন্তানরা সবাই সংসার ও কর্মজীবন নিয়ে ব্যস্ত। কিন্তু যখনই জানতে পারেন মা আবারও হারিয়ে গেছেন, তখনই সব কাজ ফেলে ছুটে আসেন। সেই মুহূর্তে সময় থেমে যায়, শুধু থাকে উদ্বেগ আর অসহায়তার মিশ্র অনুভূতি। সীমাহীন ভালোবাসা নিয়ে দিবানিশি পাশে থাকেন দীর্ঘ সংসার জীবনের সঙ্গী বিশ্বনাথ। শিশুর মতো যত্ন নেন স্ত্রীর। মুখে ভাত তুলে দেন, ওষুধ খাওয়ান–একটুও বিরক্ত হন না। সবচেয়ে বেদনাদায়ক ব্যাপার–আরতী এখন আর স্বামীকেই চিনতে পারেন না। তিনি আরতী দেবীর কাছে এক অচেনা মানুষ। বিশ্বনাথের চোখে অশ্রু, আরতীর শূন্য দৃষ্টি।

এই গল্পটি ভারতীয় সিনেমা ‘বেলা শুরু’ থেকে। এটি কেবল একটি সিনেমার কাহিনী নয়, এটি এখন বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি। পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি দেশে এমন অসংখ্য আরতী ও বিশ্বনাথ আছেন, যারা এই কঠিন রোগের যন্ত্রণায় নিঃশব্দে দিন কাটাচ্ছেন। স্মৃতি মুছে গেলেও ভালোবাসা হারায় না–এটাই ডিমেনশিয়ার সবচেয়ে নিঃশব্দ অথচ গভীর বেদনা।

ডিমেনশিয়া কী ?

ডিমেনশিয়া হলো একটি স্নায়বিক ব্যাধি যা স্মৃতিশক্তি হ্রাস, চিন্তাভাবনা ও সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা কমে যাওয়া এবং মেজাজ ও আচরণের পরিবর্তনের মতো লক্ষণ সৃষ্টি করে। লক্ষণগুলো সময়ের সাথে সাথে ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে।

যেসব কারণে ডিমেনশিয়া হতে পারে

ডিমেনশিয়ার কারণ শনাক্ত করতে বিশ্বজুড়ে নানা গবেষণা পরিচালিত হয়েছে। এসব গবেষণায় দেখা গেছে, ডিমেনশিয়া একাধিক জটিল কারণে হয়, যার মধ্যে সবচেয়ে সাধারণ কারণ হলো আলঝাইমার্স রোগ। বয়স যত বাড়ে স্মৃতি হারানোর ঝুঁকিও তত বৃদ্ধি পায়। এছাড়া স্ট্রোক, মস্তিকে আঘাত, সংক্রমনে মস্তিকের কোষের ক্ষতি, অক্সিজেনের অভাবজনিত সমস্যা, কিছু ওষুধের প্রভাব এবং অন্যান্য স্নায়বিক রোগও ডিমেনশিয়ার কারণ হতে পারে। এখানেই শেষ নয়। গবেষণায় দেখা যায়, অপুষ্টি, উচ্চ রক্তচাপ এবং ডায়াবেটিস ডিমেনশিয়ার ঝুঁকি বহুগুণে বাড়িয়ে তোলে। অর্থাৎ, এটি শুধু মস্তিস্কের রোগ নয়, বরং পুরো শরীরের স্বাস্থ্য ও জীবনধারার সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কিত একটি জটিল সমস্যা।

বাংলাদেশে ডিমেনশিয়ার উপর পাওয়া প্রতিবেদনটি ২০১৫ সালের। তবে সাম্প্রতিক বেশ কয়েকটি গবেষণা (২০২৩–২০২৫) এর প্রাদুর্র্ভাব এবং ঝুঁকির কারণগুলোর উপর আপডেট তথ্য সরবরাহ করে। দ্য ল্যানসেট অনুসারে, ২০২৩ সালে করা একটি গবেষণায় দেখা গেছে–বাংলাদেশে ৬০ বছর বা তার বেশি বয়সী প্রায় ৮.০% ব্যক্তির ডিমেনশিয়ায় থাকতে পারে, যা ২০২০ সালে আনুমানিক ১.১ মিলিয়ন কেস। যার মধ্যে নারীদের আক্রান্ত হওয়ার হার বেশি। এর পেছনে রয়েছে বেশ কিছু কারণ। নারীদের গড় আয়ু পুরুষদের তুলনায় বেশি। ফলে বয়সজনিত ডিমেনশিয়ার ঝুঁকিও তাদের মধ্যে বেশি দেখা যায়। অনেক নারীর ক্ষেত্রে পুষ্টিহীনতা, মানসিক চাপ ও সামাজিক একাকিত্বও ডিমেনশিয়ার ঝুঁকি বাড়িয়ে তোলে। জাতীয় গড়ের তুলনায় রাজশাহী(১৫%) এবং রংপুর(১২%) বিভাগে এর প্রাদুর্র্র্ভাব বেশি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) এর তথ্য মতে, ২০০০ সালের পর থেকে বিশ্বে ডিমেনশিয়া রোগীর সংখ্যা দ্বিগুন হয়েছে। একবিংশ শতাব্দীর এই বাস্তবতায় ডিমেনশিয়া এখন কেবল একটি রোগ নয়, এটি মানবতার এক নীরব বিপর্যয়। আরো ভয়াবহ তথ্য হলো–বিশ্বজুড়ে মৃত্যুর পঞ্চম প্রধান কারণ ডিমেনশিয়া।

ডিমেনশিয়া প্রতিরোধে কিছু কার্যকর পদক্ষেপ

ডিমেনশিয়া পুরোপুরি নিরাময়যোগ্য নয়, তবে সঠিক জীবনধারা ও সচেতনতা এর ঝুঁকি অনেকাংশে কমাতে পারে। প্রত্যেকের প্রয়োজন স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, সামাজিক ও মানসিক সম্পৃক্ততা এবং শারীরিক কাজ ও ব্যায়ামের মাধ্যমে ব্যক্তিগত সক্ষমতা বজায় রাখা। স্মৃতিকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে জীবনকেই সচল রাখতে হবে। স্বাস্থ্যকর খাদ্য, সচল মন আর সক্রিয় দেহ–এই তিনের সমন্বয়েই হতে পারে ডিমেনশিয়া প্রতিরোধের সবচেয়ে কার্যকর উপায়।

ডিমেনশিয়া রোগীর যত্নে কেয়ারগিভারের ভূমিকা

ডিমেনশিয়া এমন একটি রোগ, যেখানে রোগী নিজে তার সমস্যাগুলো প্রকাশ করতে পারেন না। তারা বুঝতে পারেন না–কী হচ্ছে তাদের সঙ্গে, কোথায় কষ্ট হচ্ছে, এমনকি কখনো কখনো প্রিয়জনদেরকেও চিনতে পারেন না। তাই এই রোগে কেয়ারগিভার বা যত্নদাতার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রোগটি বাড়ার সাথে সাথে কেয়ার গিভারের উপর নির্ভরতা ক্রমশ বৃদ্ধি পায়। তারা দৈনন্দিন কাজকর্মে, সময়মত খাবার ও ওষুধ গ্রহণে সহায়তা প্রদান করেন।

সন্তানরা– ছেলে বা মেয়ে–যদি তারা সক্ষম হন, নিজেরাই বাবা বা মায়ের যত্ন নিতে পারেন। কিন্তু অনেকসময় কর্মব্যস্ততা বা পারিবারিক সীমাবদ্ধতার কারণে সেটা সম্ভব হয় না। তখন অন্য কেউ বেতনভুক্ত অথবা বিনা পারিশ্রমিকে এই দায়িত্ব পালন করতে পারেন। শিক্ষিত ও সচ্ছল পরিবারগুলোতে রোগীর প্রয়োজনীয় যত্ন, ওষুধ গ্রহণ ও চিকিৎসা ঠিকভাবে হয়। কিন্তু দরিদ্র ও অশিক্ষিত পরিবারে ডিমেনশিয়া রোগীর অবস্থা অত্যন্ত কষ্টকর। পরিবারের সদস্যরা অনেক সময় জানেন না–এই রোগ কী, কেমন করে যত্ন দরকার, কীভাবে রোগীর আচরণ বুঝতে হয়। ফলে রোগী একাকিত্ব, অবহেলা ও মানসিক যন্ত্রণায় ভোগেন।

স্মৃতিহীনদের পাশে একটি সরকারি উদ্যোগ

ডিমেনশিয়া কেয়ার ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ ২০১৬ সালে প্রতিষ্ঠিত একটি জাতীয় সংস্থা। এই সংস্থাটি বাংলাদেশে জনগণের মধ্যে ডিমেনশিয়া সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি, রোগী ও পরিবারের সহায়তা এবং কেয়ারগিভারদের প্রশিক্ষণ প্রদান করে থাকে। তারা ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য মানসিক, সামাজিক ও চিকিৎসাগত সহায়তা দিতে কাজ করছে। জরুরি সহায়তার জন্য সংস্থাটির একটি হটলাইন নম্বর আছে।

মানবতার এক নীরব পরীক্ষার নাম ডিমেনশিয়া

ডিমেনশিয়া আজ কেবল চিকিৎসা নয়, মানবিকতারও এক চ্যালেঞ্জ–যেখানে স্মৃতি হারানো মানুষগুলো আমাদের করুনা নয়, ভালোবাসা ও যত্নের দাবিদার।

আল্লাহ্‌ তায়ালা বার্ধক্য সম্পকে সতর্ক করে বলেছেন, ‘আল্লাহ্‌ই তোমাদের সৃষ্টি করেছেন, পরে তিনি মৃত্যু ঘটাবেন এবং তোমাদের মধ্যে কাউকে জরাগ্রস্ত করা হবে। ফলে, ওরা যা কিছু জানত সে সম্বন্ধে সজ্ঞান থাকবে না। আল্লাহ্‌ সর্বজ্ঞ, সর্ব শক্তিমান।’ (সুরা আন–নাহল, আয়াত ৭০)

এই আয়াত আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, বৃদ্ধ বয়সে মানুষ শিশুর মতো অসহায় হয়ে পড়ে। তখন তাদের যত্ন নেওয়া শুধু মানবিক নয়, ধর্র্র্র্মীয় ও নৈতিক দায়িত্বও বটে।

স্মৃতি হারালেও সম্পর্ক যেন না হারায়

যখন আমাদের নিকটতম স্বজন ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত হন, তখনই আমরা সত্যিকার অর্র্থে এই রোগের যন্ত্রণা অনুভব করতে পারি। আমরা বুঝি এ রোগ মানবজীবনের এক ভয়াবহ অবস্থা–যখন একজন মানুষ ধীরে ধীরে তার স্মৃতি, চিন্তা ও পরিচয় হারিয়ে ফেলেন। মানুষ বেঁচে থাকে স্মৃতির ভরসায়, অথচ এ রোগ সেই স্মৃতিই কেড়ে নিচ্ছে। প্রিয়জনদের মুখ ভুলে যাওয়া, নিজের অস্তিত্ত্ব হারিয়ে ফেলা–এ যেন জীবিত অবস্থায় মৃত্যুর সমান এক যন্ত্রণা।

ডিমেনশিয়া শুধু রোগীর জীবনে নয়, একটি পুরো পরিবারের মানসিক, সামাজিক ও আর্থিক পরিস্থিতির উপর প্রভাব ফেলে। সরকার, বেসরকারি সংস্থা, চিকিৎসক, স্বেচ্ছাসেবক এবং সচেতন নাগরিক সমাজ–সবার মিলিত উদ্যোগেই এই রোগ মোকাবেলা করা সম্ভব। ডিমেনশিয়া রোগী ও তাদের পরিবারের পাশে আমাদের সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া দরকার। কারণ কে জানে–আগামী দিনে আমরাও হয়তো এই অসহায় অবস্থার শিকার হতে পারি! আজ যারা ভুলে যাচ্ছে, কাল আমরা হতে পারি তাদের মতো–তাই এখনই সময় সচেতনতার, যত্নের ও ভালোবাসার।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *