কেবল দিবস পালন নয়, চাই মানসিকতার পরিবর্তন

​২৫ নভেম্বর থেকে ১০ ডিসেম্বর। ক্যালেন্ডারের পাতায় এই ১৬টি দিন বিশ্বজুড়ে নারী অধিকার কর্মীদের কাছে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। প্রতি বছর এই সময়টিতে আন্তর্জাতিকভাবে পালন করা হয় ‘নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে ১৬ দিনের কর্মসূিচ’ (১৬ উধুং ড়ভ অপঃরারংস ধমধরহংঃ এবহফবৎ–ইধংবফ ঠরড়ষবহপব)। নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং এটি মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন–এই বার্তাটিই বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে দেওয়া হয় এই দিনগুলোতে।

​কেন এই ১৬ দিন?

​এই কর্মসূচির সময়কাল নির্বাচন করা হয়েছে অত্যন্ত সচেতনভাবে। ২৫ নভেম্বর ‘নারীর প্রতি সহিংসতা বিলোপ দিবস’ দিয়ে এর শুরু এবং ১০ ডিসেম্বর ‘বিশ্ব মানবাধিকার দিবস’ দিয়ে এর সমাপ্তি। এই দুটি তারিখকে এক সুতোয় গাঁথার মূল উদ্দেশ্য হলো বিশ্ববাসীকে মনে করিয়ে দেওয়া যে, নারীর প্রতি সহিংসতা এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন একে অপরের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। নারীর সুরক্ষা নিশ্চিত করা ছাড়া মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করা অসম্ভব।

​এই কর্মসূচির প্রতীকী রঙ হলো ‘কমলা’ । কমলা রঙ উজ্জ্বল ভবিষ্যতের প্রতীক। এমন এক ভবিষ্যৎ যেখানে নারী ও মেয়েশিশুর বিরুদ্ধে কোনো সহিংসতা থাকবে না। জাতিসংঘের ‘ইউনাইটেড’ ক্যাম্পেইন এ সময় বিশ্বজুড়ে ‘অরেঞ্জ দ্য ওয়ার্ল্ড’ (ঙৎধহমব ঃযব ডড়ৎষফ) স্লোগান নিয়ে কাজ করে।

​বর্তমান বাস্তবতা হলো, ​যদিও আমরা একবিংশ শতাব্দীতে বাস করছি, তবুও পরিসংখ্যান বলে, বিশ্বজুড়ে প্রতি তিনজনের মধ্যে একজন নারী তার জীবদ্দশায় কোনো না কোনোভাবে শারীরিক বা যৌন নির্যাতনের শিকার হন। আমাদের দেশেও চিত্রটি ভিন্ন নয়। ঘরে–বাইরে, কর্মক্ষেত্রে, এমনকি সাইবার জগত বা অনলাইনেও নারীরা প্রতিনিয়ত হয়রানির শিকার হচ্ছেন।

​এই ১৬ দিনের কর্মসূচি আমাদের সামনে কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন ও দায়িত্ব নিয়ে আসে।

দেশে নারী ও শিশু নির্যাতন দমনে কঠোর আইন রয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, ভুক্তভোগীরা কি সহজে বিচার পাচ্ছেন? বিচারহীনতার সংস্কৃতি দূর করতে রাষ্ট্রকে আরও কঠোর হতে হবে। সহিংসতার বীজ রোপিত হয় পরিবার থেকে। ছেলেশিশুকে শেখাতে হবে নারীকে সম্মান করতে এবং মেয়েশিশুকে শেখাতে হবে অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে। ‘ভিক্টিম ব্লেমিং’ বা দোষটা নারীর ঘাড়েই চাপিয়ে দেওয়ার মানসিকতা থেকে সমাজকে বেরিয়ে আসতে হবে। পোশাক বা চলাফেরা নয়, অপরাধীর অপরাধী মন–মানসিকতাই সহিংসতার জন্য দায়ী।

নারীর প্রতি সহিংসতা রোধ কেবল নারীদের লড়াই নয়। পুরুষদেরও এখানে মিত্র হিসেবে এগিয়ে আসতে হবে। সাইলেন্ট স্পেক্টেটর বা নীরব দর্শক না হয়ে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতে হবে পুরুষদেরই। ​১৬ দিনের এই কর্মসূচি কেবল সেমিনার, র‌্যালি বা আলোচনার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না। এটি হতে হবে একটি দীর্ঘমেয়াদী অঙ্গীকার। রাষ্ট্র, সমাজ এবং ব্যক্তিপর্যায়ে আমাদের শপথ নিতে হবে, নারীদের জন্য একটি নিরাপদ পৃথিবী গড়ার।

​আসুন, এই ১৬ দিনকে পুঁজি করে বছরের বাকি ৩৪৯ দিনও নারীর প্রতি সম্মান ও সুরক্ষা নিশ্চিত করি। কারণ, সহিংসতামুক্ত সমাজ কেবল নারীর জন্য নয়, পুরো মানবতার জন্যই জরুরি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *