নাসার ১৬ কারখানা বন্ধ, হাজারো শ্রমিকের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত

সাভারের আশুলিয়া নিশ্চিন্তপুর এলাকার মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন চার বছর ধরে নাসা সুপার গার্মেন্টস লিমিটেডে হেলপার পদে চাকরি করে আসছিলেন। বাবা-মা, ভাই-বোনকে নিয়ে ভালোই চলছিল তার সংসার। কিন্তু হঠাৎ নাসা গ্রুপের কারখানা বন্ধের ঘোষণায় দিশেহারা হয়ে পড়েছেন তিনি।

নাসির বলেন, “দুই মাসের বেতন বকেয়া রয়েছে। কবে বেতন দেবে এর কোনো নিশ্চয়তা নেই। হাতে জমা টাকা যা আছে হয়ত মাসখানেক চলতে পারব। এরপর কী করব বুঝতে পারছি না।”

এই অবস্থায় কোথাও গিয়ে কাজও পাচ্ছেন না এ গ্রুপের শ্রমিকরা। নাসা গ্রুপের নাম শুনলেই বিদায় করে দিচ্ছে। কারণ শ্রমিকরা আন্দোলন করেছেন। তাদের কারও কারও নামে মামলাও হয়েছে।

নাসির বলেন, “তাহলে আমাদের কারখানা চালু না হলে না খেয়ে মরতে হবে। আমরা চাই, সরকার আমাদের কারখানা পুনরায় চালু করে দিক।”

এই দাবি নাসিরের মত চাকরিহারা আরও হাজারো শ্রমিকের। তারা প্রত্যেকই প্রায় একই সমস্যার মধ্যে পড়েছেন। কেউ বাসা ভাড়া দিতে পারছেন না, কেউ দোকানের বাকি শোধ করতে পারছেন না, কেউ সন্তানের প্রাইভেট শিক্ষককে বেতন দিতে পারছেন না। অনেকে অসুস্থ বাবা-মাকে নিয়ে নিদারুণ কষ্টের মধ্যে পড়েছেন।

একসঙ্গে নাসা গ্রুপের ১৬টি পোশাক কারখানা স্থায়ীভাবে বন্ধের ঘোষণায় প্রায় ৩০ হাজার শ্রমিকের ভবিষ্যত অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। বেতন-ভাতা বকেয়া থাকায় তারা চরম কষ্টের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন।

২০২৪ সালের ৫ অগাস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলে আত্মগোপনে চলে যান নাসা গ্রুপের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার। তিনি এক্সিম ব্যাংকেরও চেয়ারম্যান ছিলেন। ২ অক্টোবর তিনি গ্রেপ্তার হন। দুর্নীতি ও অর্থ আত্মসাতের কয়েকটি মামলায় আসামি করা হয় তাকে।

এর পর থেকেই অস্থিরতা তৈরি হয় নাসা গ্রুপের কারখানাগুলোতে। শ্রমিকদের বেতন-ভাতা বকেয়া পড়তে থাকে; অপরদিকে শ্রমিকরা বিক্ষোভে নামেন।

গত সপ্তাহে কলকারখানা প্রতিষ্ঠান ও পরিদর্শন অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয়ে শ্রমিক নেতাদের উপস্থিতিতে ত্রিপক্ষীয় সভায় নাসা গ্রুপের ১৬টি কারখানা বন্ধ ঘোষণা করা হয়। বলা হয়, বিদ্যুৎ-গ্যাসসংকট ও ক্রয়াদেশ না থাকায় ২৫ সেপ্টেম্বর থেকে এসব কারখানার সব কার্যক্রম বন্ধ থাকবে।

বন্ধ কারখানাগুলোর মধ্যে রয়েছে আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুর এলাকায় ১০টি, গাজীপুরে দুটি, চট্টগ্রাম ইপিজেডে দুটি এবং কুমিল্লা ইপিজেডে দুটি কারখানা।

স্থায়ীভাবে বন্ধ নাসা গ্রুপের ১৬টি কারখানার মধ্যে শিল্পাঞ্চল আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুর এলাকায় রয়েছে এ জে সুপার গার্মেন্টস লিমিটেড, ফিরোজা গার্মেন্টস লিমিটেড, মাম গার্মেন্টস লিমিটেড, নাসা এমব্রয়ডারি লিমিটেড, নাসা সুপার গার্মেন্টস লিমিটেড, নাসা সুপার ওয়াশ লিমিটেড, নাসা সুপার ওয়াশ ইউনিট- (২), ন্যাটিভ প্যাকেজিং লিমিটেড, নাসা বেসিক লিমিটেড, নাসা হাইটেক ওয়াস লিমিটেড। গাজীপুরে অবস্থিত লিজ অ্যাপারেলস লিমিটেড, লিজ ওয়াস লিমিটেড। চট্টগ্রাম ইপিজেডে অবস্থিত এমএনসি অ্যাপারেলস লিমিটেড, টয় গুডস বিডি কোম্পানি লিমিটেড এবং কুমিল্লায় ইপিজেডে অবস্থিত নাসা স্পিনারস লিমিটেড ও নাসা স্পিনিং লিমিটেড।

এদিকে বন্ধ কারখানা খুলে দেওয়াসহ বকেয়া বেতনের দাবিতে আশুলিয়ায় ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ, মানববন্ধন করেন নাসা গ্রুপের শ্রমিকরা। তাতে সড়কে যানজটের সৃষ্টি হয়ে চরম ভোগান্তিতে পড়েন সড়ক ব্যবহারকারীরা। পরে পুলিশ জলকামান ব্যবহার করে এবং লাঠিপেটা করে আন্দোলনকারীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়।

‘আমাদের সংসার কীভাবে চলবে?’

নাসা গ্রুপের একটি কারখানার শ্রমিক ইমরান হোসেন বলেন, তিন বছর ধরে তিনি এ কারখানায় কাজ করছেন।

“স্ত্রী-সন্তান নিয়ে ভালোই ছিলাম। হঠাৎ কারখানা বন্ধ হওয়ায় দুশ্চিন্তায় পড়ে গেছি। অন্য কারখানায় গেলেও যদি চাকরি না হয়, তাহলে পরিবারের মুখে খাবার তুলে দেব কীভাবে? নতুন কোনো কর্মসংস্থান না হলে অর্ধাহারে- অনাহারে দিন কাটাতে হবে।”

নাসা সুপার গার্মেন্টস লিমিটেডের হেলপার তৌহিদুল ইসলাম বলেন, “বকেয়া বেতন-ভাতার দাবিতে আমরা আন্দোলন করছিলাম। এরই মধ্যে কারখানায স্থায়ীভাবে বন্ধের খবর পেলাম। আমরা এখন কী করব বুঝতে পারছি না। কারখানা চালু না হলে আমাদের সংসার কীভাবে চলবে। বাড়িতে বাবা-মা, ভাই-বোন রয়েছে। হাতে যা আছে তা দিয়ে হয়ত মাসখানে চলবে। এরপর নতুন কাজ না হলে মহাবিপদে পড়তে হবে।”

বাংলাদেশ গার্মেন্টস অ্যান্ড শিল্প শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি রফিকুল ইসলাম সুজন বলেন, “হাজার হাজার শ্রমিকের কর্মসংস্থানের পথ বন্ধ করে দিয়ে কারখানা বন্ধ করা মোটেও ঠিক হয়নি। কারখানা বন্ধ করার আগে এত শ্রমিক কিভাবে জীবিকা নির্বাহ করবে এটা ভাবা উচিত ছিল।

“এখন বেকার এই হাজার হাজার শ্রমিক কোথায় যাবে, কী করবে? কী করে তাদের সংসার চালবে এটাই ভাবার বিষয়। আমরা কারখানা খুলে দেওয়ার দাবি জানাচ্ছি।”

এসব বিষয়ে কথা বলতে নাসা গ্রুপের কয়েকজন কর্মকর্তাকে ফোন করা হলেও তারা ধরেননি।

বকেয়া পরিশোধে সমঝোতা

নাসা গ্রুপের শ্রমিকদের বকেয়া পাওনা পরিশোধে সমঝোতা চুক্তি সই হয়েছে। ২৩ সেপ্টেম্বর শ্রম ভবনে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের সভাকক্ষে শ্রমিক, মালিক ও সরকারের মধ্যে ত্রিপক্ষীয় সভায় এই সিদ্ধান্ত হয়।

সমঝোতা চুক্তি অনুসারে, কারখানার কর্তৃপক্ষ ১৫ অক্টোবর আগস্ট মাসের বকেয়া বেতন-ভাতা (মজুরি) এবং ৩০ অক্টোবর সেপ্টেম্বর মাসের বকেয়া বেতন-ভাতাদি (মজুরি) পরিশোধ করবে।

এ ছাড়া বাংলাদেশ শ্রম আইন অনুযায়ী, প্রত্যেক পূর্ণ বছর চাকরির জন্য ৩০ দিনের মূল মজুরি ও মাতৃত্বকালীন ছুটির টাকা পরিশোধ করা হবে।

শ্রমিকদের এসব যাবতীয় আইনানুগ পাওনা আগামী ৩০ নভেম্বর পরিশোধ করা হবে। কোনো শ্রমিককে ইন্টারনেট/ডেটাবেজে কালো তালিকাভুক্ত করা যাবে না।

কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শকের (যুগ্ম সচিব) সভাপতিত্বে ওই সভা হয়। সভায় শ্রমিক প্রতিনিধি, কারখানা কর্তৃপক্ষ, সরকারপক্ষ এবং বিজিএমইএর প্রতিনিধিরা সমঝোতা স্মারকে সই করেন।

এ সময় কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের কর্মকর্তা, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও শিল্প পুলিশের প্রতিনিধি, গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিনিধি, বিজিএমইএর সহসভাপতি, নাসা গ্রুপের প্রতিনিধি এবং শ্রমিক ও মালিকপক্ষের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।

২০ সেপ্টেম্বর শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপে কারাগারে থেকেই সম্পত্তি বিক্রির ‘পাওয়ার অব অ্যাটর্নি’ নথিতে নজরুল ইসলাম মজুমদার স্বাক্ষর করেন বলে সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হয়।

‘সম্পদ বিক্রি সমাধান নয়’

নাসা গ্রুপ ১৯৯০ সালে যাত্রা শুরু করে। তারপর থেকে দ্রুত সম্প্রসারিত হয়ে দেশের অন্যতম বৃহত্তম পোশাক রপ্তানিকারক কোম্পানিতে পরিণত হয়।

পোশাক উৎপাদন ছাড়াও ব্যাংকিং, রিয়েল এস্টেট, শেয়ার ব্রোকারেজ, শিক্ষা ও ভ্রমণসহ বিভিন্ন খাতে তাদের ব্যবসা রয়েছে। এই গ্রুপের ৩৪টি কারখানায় কাজ করেন ৩০ হাজারের বেশি শ্রমিক।

বাংলাদেশ গার্মেন্টস ও সোয়েটারস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের আইনবিষয়ক সম্পাদক খায়রুল মামুন মিন্টু বলেন, গত ১০ সেপ্টেম্বর সাভার গলফ ক্লাবে নাসা গ্রুপের নাসা বেসিক কমপ্লেক্স, এ জে সুপার কমপ্লেক্স ও নাসা সুপার কমপ্লেক্সের অসন্তোষ নিয়ে সমন্বয় সভা হয়।

“সভায় মালিকপক্ষ ১১ সেপ্টেম্বর হাতিরঝিল ডিপোতে থাকা নাসার আড়াই থেকে তিন কোটি টাকার খেজুর বিক্রি, ১৭ সেপ্টেম্বর আশুলিয়ার ঘোষবাগ এলাকার ৩০ কোটি টাকা দামের জমিসহ ছয়তলা ভবন বিক্রি এবং ২৫ সেপ্টেম্বরের মধ্যে গুলশান-২ এর ৪০০ কোটি টাকা মূল্যের জমি বিক্রি করে শ্রমিক-কর্মচারী-কর্মকর্তাদের বেতন-ভাতা পরিষদের আশ্বাস দেন।”

এই শ্রমিক নেতা মনে করেন, জমি, কারখানা ভবন বিক্রি করে শ্রমিকদের পাওনা পরিশোধ করা কোনো ‘সমাধান নয়’।

“বন্ধ কারখানা কীভাবে চালু করা যায় সে উদ্যোগ সরকারকে নিতে হবে। আশুলিয়ার নাসা গ্রুপে হাজার হাজার শ্রমিক রয়েছে। কারখানা চালু না হলে এ শ্রমিকদের অবস্থা কী হবে, তাদের পরিবারের অবস্থা কী হবে?”

গত এক বছরে লক্ষাধিক শ্রমিকের চাকরি হারানোর তথ্য তুলে ধরে শ্রমিক নেতারা বলছেন, বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান বন্ধের সিদ্ধান্ত যখন আসে, তখন এর কারণ নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। মালিকের ব্যক্তিগত বা রাজনৈতিক অবস্থান যাই হোক না কেন, এত বিপুল সংখ্যক শ্রমিকের কর্মসংস্থান নিয়ে এমন একটি সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে সরকারের ভূমিকা রাখা দরকার।

গ্রেপ্তার ৭ শ্রমিক

আশুলিয়ার নরসিংহপুর এলাকায় নাসা গ্রুপের শ্রমিক অসন্তোষের ঘটনায় সাতজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তবে একজন ছাড়া অন্যদের পরিচয় প্রকাশ করা হয়নি।

আশুলিয়া থানার ওসি মো. আব্দুল হান্নান বলেন, ২৫ সেপ্টেম্বর আশুলিয়ার বিভিন্ন এলাকা থেকে সাতজনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আনা হয়েছিল। পরবর্তীতে শিল্পাঞ্চল পুলিশের করা মামলায় তাদের গ্রেপ্তার দেখানো হয়।

ঢাকা জেলা উত্তর গোয়েন্দা পুলিশের ওসি মো. জালাল উদ্দিন বলেন, “শ্রমিক আন্দোলনের নামে যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করা হচ্ছিল, তার নেপথ্যে রয়েছে টিপু সুলতান। তাকে আমরা জামগড়া এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করেছি।”

টিপু সুলতান ঝিনাইদহ জেলার শৈলকুপা থানার পূর্ব মাদলা গ্রামের ছেলে। তিনি পরিবার নিয়ে নরসিংহপুর ইটখোলা এলাকার নাসু মিয়ার বাড়িতে ভাড়া থাকেন। একসময় তিনি ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন।

শিল্প পুলিশ-১ এর পুলিশ সুপার মোমিনুল ইসলাম ভুঁইয়া বলেন, “নাসা গ্রুপের বন্ধ কারখানার শ্রমিকরা যাতে মহাসড়কে নেমে কোনো বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে না পারে, সেজন্য অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন রয়েছে।”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *