চট্টগ্রাম-কক্সবাজার : ট্রেনে স্বস্তি, সড়কে আতংক

চট্টগ্রাম–কক্সবাজার মহাসড়ক যাত্রীদের কাছে এখন আতংকের একটি নামে পরিণত হয়েছে। দেশের বৃহত্তম একটি পর্যটন নগরীর সাথে সড়ক যোগাযোগের এই মহাসড়কটিতে প্রতিনিয়ত ঘটছে দুর্ঘটনা; ঘটছে প্রাণহানি। বাড়ছে পঙ্গুত্ব। আর সেই সাথে মৃত্যুও। তবে সড়কের এই আতংকের মাঝে কিছুটা স্বস্তি ফিরিয়ে দিয়েছে পর্যটন নগরীর সাথে রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা। ২০২৩ সালের ১১ নভেম্বর চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ১০২ কিলোমিটার রেললাইন উদ্বোধন হয়। এরপর ২০২৩ সালের ১ ডিসেম্বর ঢাকা–কক্সবাজার রুটে কক্সবাজার এক্সপ্রেস ট্রেন চালচল শুরু হয়। ২০২৪ সালের ১০ জানুয়ারি থেকে যুক্ত হয় পর্যটক এক্সপ্রেস ট্রেন। চলতি বছরের ১ ফেব্রুয়ারি থেকে চট্টগ্রাম–কক্সবাজার রুটে চালু করা হয় ‘সৈকত এক্সপ্রেস’ ও ‘প্রবাল এক্সপ্রেস’ নামে আরও দুটি ট্রেন। বর্তমানে ঢাকা–চট্টগ্রাম–কক্সবাজার রেলপথে ৪টি ট্রেন চলাচল করে।

কক্সবাজারের সড়ক যোগাযোগ যখন একেবারেই নাজুক অবস্থানে, তখন দেশের বৃহত্তম পর্যটন নগরীর যাত্রীদের কাছে অনেকটা স্বস্তির বাহন হিসেবে ট্রেন যোগাযোগ ব্যবস্থা আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। কক্সবাজারগামী প্রতিটি ট্রেনের আসনের বিপরীতে দ্বিগুণের বেশি যাত্রীর চাহিদা রয়েছে। কিন্তু কর্তৃপক্ষ এই রুটে পর্যাপ্ত ট্রেন দিতে না পারায় সারাদেশের যাত্রীদের চাহিদা পূরণ করতে পারছে না।

কক্সবাজার মহাসড়কের বাস চালক ও হাইওয়ে পুলিশের সদস্যরা জানান, দুই লেইনের মহাসড়কটির ধারণ ক্ষমতার চেয়ে ১০ গুণ বেশি যানবাহন চলাচল করে। এই মহাসড়কটি এখন ‘মরণফাঁদ’–এ পরিণত হয়েছে। মহাসড়কটিতে দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিল যেন থামছেই না। দেশের বৃহত্তম পর্যটন নগরী কক্সবাজারের সাথে সারাদেশের মানুষের সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা অত্যন্ত নাজুক। এই মহাসড়কটি এখনো মাত্র দুই লেইনের।

সড়ক ও জনপথ বিভাগের সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীরা জানান, চট্টগ্রাম–কক্সবাজার মহাসড়কটি চার লেইন উন্নীতকরণ প্রকল্পের বাস্তব অগ্রগতি এখনো শূণ্যের পর্যায়ে। জাইকা মাত্র সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ করছে।

জাইকার অপর প্রকল্পে ৫টি বাইপাস ও ফ্লাইওভার নির্মাণ কার্যক্রমের অগ্রগতি ১ দশমিক ৫০ শতাংশ। এই প্রকল্পটি ২০২৩ সালে একনেকে অনুমোদন হয়েছিল।

জানতে চাইলে চট্টগ্রাম–কক্সবাজার মহাসড়ক সমপ্রসারণ প্রকল্পের পরিচালক প্রকৌশলী শ্যামল কুমার ভট্টাচার্য্য বলেন, চট্টগ্রাম–কক্সবাজার মহাসড়কের ৫টি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে বাইপাস ও ফ্লাইওভার নির্মাণ প্রকল্পের আর্থিক অগ্রগতি কিছুটা থাকলেও গড় ভৌত অগ্রগতি এখনো শূণ্য।

চট্টগ্রাম–কক্সবাজার মহাসড়কের ২৩ দশমিক ৫২ কিলোমিটারে ৫টি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে বাইপাস ও ফ্লাইওভার নির্মাণ প্রকল্পে জাইকার সাথে ঋণ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। পরামর্শক নিয়োগে টেন্ডার আহ্বানে অনুমোদনের জন্য মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছি। মন্ত্রণালয় থেকে অনুমোদন পাওয়ার পর আন্তর্জাতিক টেন্ডার আহ্বান করা হবে।

মহাসড়কের ৫টি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে বাইপাস ও ফ্লাইওভার নির্মাণ প্রকল্পের বাইরে দ্বিতীয় পর্যায়ে চার লেনের মহাসড়ক নির্মাণে আলাদা আরেকটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। এটার সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ চলমান। এটিরও অর্থায়নে জাইকা আগ্রহ দেখিয়েছে। তবে এটি এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। জাইকার সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ শেষ হলে তারপর ডিপিপি তৈরি হবে।

হাইওয়ে পুলিশ, প্রশাসন ও সড়ক পরিবহন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চট্টগ্রাম–কক্সবাজার মহাসড়কে একাধিক কারণে এসব দুর্ঘটনা ঘটছে। গত দুই মাসে মহাসড়কটিতে দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ৪০ জনের মত। সড়কটিতে ত্রুটিপূর্ণ বিপজ্জনক বাঁক এবং লবণবাহী ট্রাকের পানির কারণে এটি পিচ্ছিল হয়ে আরও বেশি বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে।

চট্টগ্রাম–কক্সবাজার মহাসড়কের পরিবহন শ্রমিক ও বাস চালকদের বেশ কয়েকজনের সাথে কথা হলে তারা জানান, চট্টগ্রাম থেকে লোহাগাড়া পর্যন্ত মহাসড়কের দূরত্ব ৪৫ কিলোমিটার। চকরিয়া থেকে কক্সবাজারের পর্যন্ত দূরত্ব ১১৫ কিলোমিটার। এর মধ্যে পটিয়া থেকে লোহাগাড়া ও চকরিয়া থেকে নাপিতখালী পর্যন্ত মহাসড়কের অবস্থা খুবই বিপজ্জনক। এ এলাকায় সড়ক যেমন সরু, তেমন রয়েছে শতাধিক বিপজ্জনক বাঁক। যেখানে প্রতিদিনই ঘটছে দুর্ঘটনা।

চকরিয়া ও পেকুয়া থেকে লবণবাহী ট্রাকের পানি আর ধুলোয় জমাট বেঁধে সড়ক হয়ে উঠে পিচ্ছিল। এতে প্রয়োজনীয় মুহূর্তে ব্রেক করলে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে গাড়ি দুর্ঘটনায় পতিত হয়।

সড়ক ও জনপথ বিভাগের প্রকৌশলীরা জানান, চট্টগ্রাম–কক্সবাজার মহাসড়কের কর্ণফুলী শাহ আমানত সেতুর দক্ষিণাংশ থেকে চকরিয়ার খুটাখালী পর্যন্ত ১১৫ কিলোমিটার সড়কে ৫০টির বেশি স্থানে ঝুঁকিপূর্ণ বাঁক রয়েছে। এ ছাড়া ১৫টির বেশি স্থানে সড়কের উপর রয়েছে হাটবাজার। হাইওয়ে পুলিশের মতে, একাধিক কারণে মহাসড়কটি মরণফাঁদে পরিণত হয়েছে। এছাড়াও এটি চারলেনে উন্নীত না করা, আঁকাবাঁকা পথ, দিকনিদের্শনাহীন বাঁক, অদক্ষ চালক দিয়ে ও বেপরোয়া গতিতে যান চালানো, ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন সড়কে নামানো, চলন্ত অবস্থায় বাসে যাত্রী উঠানো–নামানো, যানবাহন ক্রস করার সময় গতি না কমানো, সংকেত না দিয়ে ওভারটেকিংয়ের কারণে দুর্ঘটনা বেশি ঘটছে।

মালুমঘাট হাইওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদ মেহেদী হাসান বলেন, গত একমাসে সড়ক দুর্ঘটনায় আমার এরিয়াতে ১৬জন লোক মারা যায়। এছাড়া অনেক যাত্রী বা লোক গুরুতর আহত হয়। আমরা সকল স্তরের যানবাহন চালকদেরকে ট্রাফিক আইন মেনে চলার জন্য বিভিন্ন নির্দেশনা দিয়ে থাকি। তারপরও দুর্ঘটনা ঘটছে। এই মহাসড়কটিতে ধারণ ক্ষমতার অতিরিক্ত যানবাহন চলাচল করে।

চিরিংগা হাইওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদ আরিফুল আমিন বলেন, গত একমাসে আমার এরিয়ায় ১১জন যাত্রী মারা যান। এছাড়া অসংখ্য যাত্রী আহত হন। আমরা প্রতিনিয়ত চেষ্টা করছি চালকদের সচেতন করার জন্য। তারপরও দুর্ঘটনা ঘটছে।

উল্লেখ্য, গত ৫ নভেম্বর বেলা ১১টার দিকে কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার ফাঁসিয়াখালী এলাকায় যাত্রীবাহী বাস মারসা পরিবহনের সাথে প্রাইভেটকারের মুখোমুখি সংঘর্ষে একই পরিবারের ৫ জন নিহত হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *