ওম্যাড কি ওজন কমানোর সহজ উপায়, নাকি আছে স্বাস্থ্যঝুঁকি?

আজকাল অনেকেই ওজন কমাতে নানা ধরনের ডায়েট বেছে নিচ্ছেন। বর্তমানে ডায়েটের ট্রেন্ডে আছে প্রতিদিন একবার খাওয়া, ইংরেজিতে যাকে বলে ওম্যাড (ওয়ান মিল আ ডে)। সম্প্রতি ইনস্টাগ্রামে এক সাক্ষাৎকারে বলিউড পরিচালক করণ জোহরকেও এই ডায়েট সম্পর্কে বলতে দেখা গেছে। করণ জহর সেখানে বলেন, ‘শুধু ওষুধ বা ইনজেকশন নয়, এই আমূল পরিবর্তনের নেপথ্যে ছিল ওম্যাড। আমি এখন দিনে একবেলা খাবার খাই। প্রথম সাত দিন এটা মানিয়ে নিতে কষ্ট হলেও পরের সাত মাসে আমার ওজন বেশ কমেছে।’ ওম্যাড পদ্ধতিতে সারা দিন না খেয়ে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে একবার পরিপূর্ণ খাবার খাওয়া হয়। অনেকে মনে করেন, এতে দ্রুত ওজন কমে। এখন প্রশ্ন হলো, এটা কি সত্যিই স্বাস্থ্যকর? তাই জেনে রাখুন ওম্যাড কী, কীভাবে কাজ করে, এর উপকারিতা বা অপকারিতাই কী কী এবং কারা এই পদ্ধতি এড়িয়ে চলবেন।

ওম্যাড কী এবং কীভাবে কাজ করে

এটি মূলত একটি ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে দিনের একটি নির্দিষ্ট সময়ে খাবার খেতে হয়। অর্থাৎ প্রায় ২৩ ঘণ্টা না খেয়ে থাকার নিয়ম। তাই এটাকে খুব কড়া ডায়েট বলা যায়। তবে কেউ কেউ সামান্য হালকা নাশতা বা পানীয়ও খান মাঝখানে। এই ডায়েটের ফলে শরীরে ক্যালরির ঘাটতি তৈরি হয়, যা ওজন কমাতে সহায়ক।

ওজন কমানোর জন্য কি এটা কার্যকর

ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং ওজন কমাতে কার্যকর ও নিরাপদ উপায়, যদি-না শরীরে অন্য কোনো রোগ থাকে। দীর্ঘমেয়াদি কোনো রোগ থাকলে খাদ্যাভ্যাসে এ ধরনের পরিবর্তন আনার আগে অবশ্যই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। ওম্যাড মূলত ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং বলে এটা ওজন কমাতে সহায়ক। সুস্থ একজন অনায়াসেই তিন মাসের জন্য ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে পারেন। ২০১৮ সালের যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল লাইব্রেরি অব মেডিসিনের এক গবেষণায় দেখা গেছে, দিনে একবার খাওয়া অনেকের জন্য ওজন কমাতে কার্যকর হতে পারে। কারণ, তাঁরা স্বাভাবিকভাবেই কম ক্যালরি গ্রহণ করেন। এ ছাড়া ফাস্টিংয়ের ফলে শরীর চর্বি পোড়াতে শুরু করে, যা ওজন কমাতে সহায়ক। তবে মনে রাখতে হবে, আপনি যদি সেই একবার খাওয়ায় অতিরিক্ত ফাস্ট ফুড, চিনি বা প্রক্রিয়াজাত খাবার খান, তাহলে ওজন কমার বদলে বেড়েও যেতেও পারে।

ওম্যাডের উপকারিতা কী কী

প্রতিটি ডায়েটের উপকারিতা ও অপকারিতা আছে। ওম্যাডের উপকারিতা দেখে নেওয়া যাক।

শর্করার মাত্রা কমাতে সহায়ক

যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল লাইব্রেরি অব মেডিসিনের গবেষণায় দেখা গেছে, নিয়মিত ফাস্টিং রক্তে শর্করার মাত্রা কমাতে সাহায্য করে। পাশাপাশি এলডিএল বা খারাপ কোলেস্টেরল কমাতে সাহায্য করে।

প্রদাহ কমাতে উপকারী

যখন শরীরের কোথাও সংক্রমণ, আঘাত বা দীর্ঘমেয়াদি কোনো রোগ (যেমন হৃদ্‌রোগ, ডায়াবেটিস, আর্থ্রাইটিস) থাকে, তখন রক্তে সিআরপির (সি-রিঅ্যাকটিভ প্রোটিন) মাত্রা বেড়ে যায়। সিআরপি নামের এই আমিষ কমাতেও ফাস্টিং ভূমিকা রাখতে পারে।

স্নায়ুতন্ত্র সুস্থ রাখতে পারে

কয়েকটি গবেষণায় দেখা গেছে, ফাস্টিং মস্তিষ্কের স্বাস্থ্য ভালো রাখতে সাহায্য করতে পারে। প্রাণীদের ওপর করা এক গবেষণায় দেখা গেছে, এটি নিউরোডিজেনারেশন (মস্তিষ্ক কোষের ক্ষয়) ধীর করে এবং দীর্ঘায়ু অর্জনে সহায়তা করতে পারে।

হৃদ্‌রোগের ঝুঁকি কমাতে সহায়ক হতে পারে

২০১৭ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় বসবাসরত ৩০ বছর বা তার বেশি বয়সী ৫০ হাজার ৬৬০ জনের ওপর করা এক গবেষণায় দেখা গেছে, যাঁরা দিনে ১ বা ২ বার খাবার খেতেন, তাঁদের বার্ষিক বিএমআই (বডি মাস ইনডেক্স) কমে গিয়েছিল। বিএমএ কমলে হৃদ্‌রোগের ঝুঁকি কমে, রক্তচাপ ও ব্লাড সুগার নিয়ন্ত্রণে আসে।

ওম্যাডের অপকারিতা কী কী

অতিরিক্ত ক্ষুধা ও দুর্বলতা

দিনে একবার খাওয়া শরীরের জন্য যথেষ্ট না-ও হতে পারে, এতে অতিরিক্ত ক্ষুধা লাগতে পারে। পাশাপাশি বমি বমি ভাব, মাথা ঘোরা, শরীরে শক্তি কমে যাওয়া, কোষ্ঠকাঠিন্য, মেজাজ খিটখিটে হতে পারে।

রক্তে শর্করা বিপজ্জনক মাত্রায় কমে যেতে পারে

বিশেষ করে টাইপ-২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য হাইপোগ্লাইসেমিয়া (রক্তে শর্করা খুব কমে যাওয়া) হতে পারে, যা বিপজ্জনক।

সবার জন্য নয়

ওম্যাড ডায়েট সবার জন্য উপযুক্ত নয়। বিশেষ করে অন্তঃসত্ত্বা বা স্তন্যদায়ী নারী, শিশু বা কিশোর-কিশোরী, বয়স্ক মানুষ এবং যাঁরা খাওয়াদাওয়ার মানসিক সমস্যায় ভোগেন (যেমন ইটিং ডিজঅর্ডার), তাঁদের জন্য এটা উপযুক্ত নয়।

প্রক্রিয়াজাত বা চিনিজাতীয় খাবার বেশি খেয়ে ফেলা

এই ডায়েটে অনেকেই খাওয়ার সময় বেশি পরিমাণ ফাস্ট ফুড, পিৎজা, মিষ্টি, আইসক্রিম ইত্যাদি খেয়ে ফেলেন। এ ধরনের প্রক্রিয়াজাত, অতিরিক্ত চিনি ও চর্বিযুক্ত খাবার দীর্ঘ মেয়াদে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।

তাহলে কী করবেন

যাঁরা স্বাস্থ্যসচেতন ও ওজন কমাতে আগ্রহী, তাঁরা চাইলে একবার ওম্যাড প্রয়োগ করে দেখতে পারেন।

তবে—শুরু করার আগে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।

সপ্তাহে এক-দুদিন করে শুরু করুন।

পর্যাপ্ত পানি ও ইলেকট্রোলাইট নিন।

যথাসম্ভব পুষ্টিকর খাবার রাখুন আপনার পাতে।

শেষ করার আগে

ফাস্টিং বা ক্যালরি নিয়ন্ত্রণ ভালো হলেও দিনে দুই বা তিনবেলা স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া দেহের জন্য অনেক বেশি নিরাপদ ও কার্যকর। ওম্যাড ডায়েট খুবই কড়া এবং সবার জন্য উপযুক্ত নয়। সব শেষে করণ জোহরের ইনস্টাগ্রামে শেয়ার করা কথাটা মনে রাখবেন, ‘সুস্বাস্থ্য অর্জনে কোনো শর্টকাট নেই, দরকার কেবল সঠিক মানসিকতা’।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *