মুসলিম ব্রাদারহুড নিষিদ্ধে ট্রাম্পের নতুন উদ্যোগ

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা দিয়েছেন, আমেরিকায় মুসলিম ব্রাদারহুডের কয়েকটি শাখা নিষিদ্ধ করা হবে। একই সঙ্গে সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের অনুরোধে তিনি সুদানের গৃহযুদ্ধ বন্ধে উদ্যোগ নিচ্ছেন। বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে এক পর্যায়ে ট্রাম্প বলেন, ‘পৃথিবীতে সুদান নামে একটা জায়গা আছে’—যা আলোচনায় নতুন মাত্রা যোগ করেছে।

সুদান, সন্ত্রাসবাদ ও যুক্তরাষ্ট্র—এই তিনটির ইতিহাস বহু জায়গায় একে অন্যের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। নব্বইয়ের দশকে সুদান ওসামা বিন লাদেনকে আশ্রয় দেয় এবং সন্ত্রাসী প্রশিক্ষণ শিবির গড়ে তুলতে সহায়তা করে। বিল ক্লিনটন সরকার তাঁকে আটক বা নিস্ক্রিয় করার চেষ্টা করলেও ব্যর্থ হয়। কিছুদিন পর তিনি আফগানিস্তানে চলে যান এবং কয়েক বছরের মধ্যেই তাঁর অনুসারীরা টুইন টাওয়ার ও পেন্টাগনে হামলা চালায়। তিন হাজার মানুষ নিহত হয়, আর সেই ঘটনার পরবর্তী ‘ওয়ার অন টেরর’-এ প্রাণ হারায় প্রায় ১০ লাখ মানুষ।

ট্রাম্পের বর্তমান পরিকল্পনা—মুসলিম ব্রাদারহুডকে নিষিদ্ধ করা, সুদানের গৃহযুদ্ধ থামানো এবং যুক্তরাষ্ট্রসহ তার মিত্রদের নিরাপদ করা। কারণ আজকের সুদান আবারও পশ্চিমাবিরোধী শক্তিগুলোর নিরাপদ আশ্রয় হয়ে উঠছে। দেশটির তিনটি মূল ঝুঁকি—অ্যালাইনমেন্ট (কোন শক্তির সঙ্গে যুক্ত হওয়া), অ্যানাইহিলেশন (ধ্বংসাত্মক মনোভাব) এবং অ্যালায়েন্স (আঞ্চলিক জোট)—বোঝা গেলে শান্তি প্রতিষ্ঠার পথ খুলে যেতে পারে।

সাত দেশের সীমান্তঘেরা সুদান বহুদিন ধরেই মিসরের সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় প্রভাবের মধ্যে রয়েছে। সেখান থেকেই পঞ্চাশের দশকে মুসলিম ব্রাদারহুডের আদর্শ সুদানে ছড়িয়ে পড়ে। এই মতাদর্শ ইসলামী রাজনৈতিক শাসন প্রতিষ্ঠা, ইসরায়েলের ধ্বংস এবং ধর্মের নামে স্থায়ী সংঘাতকে উৎসাহিত করে।

১৯৮৯ সালে সেনা কর্মকর্তা ওমর আল-বশির অভ্যুত্থান করে ইসলামপন্থী সরকার প্রতিষ্ঠা করেন এবং দেশকে সরাসরি আমেরিকাবিরোধী পথে নেন। বিন লাদেনকে আশ্রয় দেওয়া ছিল সেই পথেরই অংশ। তার সরকারের সময়ে নারীদের ওপর কঠোর শরিয়াভিত্তিক আইন ও নানান নিষ্ঠুর শাস্তি চাপানো হয়। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত তাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের বহু অভিযোগ গঠন করেছে। এই সরকারের ওপর যুক্তরাষ্ট্র ক্রমাগত নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে এবং সুদানের অর্থনীতি ধুঁকতে থাকে।

২০১৯ সালে গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে বশির পতনের পর ক্ষমতায় আসে আবদাল্লা হামদকের নেতৃত্বে বেসামরিক সরকার। হামদক যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক ঠিক করা, দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের কারাগারে পাঠানো এবং আঞ্চলিক অর্থনৈতিক ব্লক—বিশেষ করে ইউএই—এর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ার মাধ্যমে সুদানকে নতুন পথে নেওয়ার চেষ্টা করেন। তাঁর বড় পদক্ষেপ ছিল ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে ট্রাম্পের উদ্যোগে গঠিত ‘আব্রাহাম অ্যাকর্ড’-এ যোগ দেওয়া।

কিন্তু পুরোনো ইসলামপন্থী গোষ্ঠীগুলো পাল্টা আঘাত হানে। ২০২১ সালে হামদকের বিরুদ্ধে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটে এবং তিনি দেশ ছাড়তে বাধ্য হন। এরপর সুদান আবারও আগের চক্রে ফিরে যায়—আমেরিকাবিরোধী অবস্থান, ব্রাদারহুডের শক্ত ঘাঁটি এবং ধ্বংসাত্মক সামরিক রাজনীতি। অভ্যুত্থানের নেতৃত্বে ছিলেন সেনাপ্রধান আল-বুরহান। অন্যদিকে আরেক সেনা–কমান্ডার ‘হেমেদতি’ আরএসএফ বাহিনী নিয়ে আলাদা শক্তি গড়ে তোলেন। দুই পক্ষের একে অপরকে ধ্বংস করার মানসিকতা আজকের যুদ্ধের মূল কারণ।

সুদানের অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়েছে ইসরায়েল–প্যালেস্টাইন সংঘর্ষেও। ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার সঙ্গে সুদান-সংযোগ পাওয়া গেছে। হামাস–সম্পৃক্ত অর্থদাতা আবদেলবাসিত হামজাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সন্ত্রাসী ঘোষণা করেছিল, অথচ সুদানের সামরিক সরকার তাঁকে মুক্তি দেয়। হামাসের আরেক শীর্ষ নেতা খলিল আল-হাইয়াও নব্বইয়ের দশকে খার্তুমে পড়াশোনা করেছেন এবং তখনই ইসলামি উগ্র নেটওয়ার্কের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত হন।

ইরানও সুদানে তার প্রভাব বাড়াচ্ছে, হুতি যোদ্ধাদের পাঠাচ্ছে এবং লোহিত সাগরের গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য রুটকে ঝুঁকির মুখে ফেলছে। ফলে সুদান এখন আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতার নতুন কেন্দ্র।

ট্রাম্পের বিশেষ উপদেষ্টা মাসাদ বুলোস শান্তি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালালেও সুদানি সেনাবাহিনী যুদ্ধবিরতি মানছে না এবং তাঁকে পক্ষপাতদুষ্ট বলে আক্রমণ করছে—কারণ তিনি ব্রাদারহুডের প্রভাব সরিয়ে দিতে চান।

এখন প্রশ্ন—সুদান আবার কীভাবে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরবে? হামদক ইতোমধ্যে দুই পক্ষকে অস্ত্র সমর্পণ করে আলোচনায় বসতে আহ্বান জানিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্ব নিলে আব্রাহাম অ্যাকর্ডভুক্ত দেশগুলোসহ আরও অনেকে সুদানের পাশে দাঁড়াতে পারে।

ইতিহাস হুবহু পুনরাবৃত্তি না হলেও তার ছায়া ফিরে আসে। সুদান এখন সেই প্রাক-৯/১১ পরিবেশের মতো পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে—যেখানে হামাস, হুতি ও তাদের অর্থদাতারা সুবিধাভোগী।
ট্রাম্প ও তাঁর প্রশাসন অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে সুদানকে দ্রুত বেসামরিক শাসনে ফেরানো, সন্ত্রাসী অর্থদাতাদের বিচারের মুখোমুখি করা এবং মুসলিম ব্রাদারহুড নিষিদ্ধের দিকে এগোচ্ছে।

শেষ পর্যন্ত যে সুদানি নেতা আমেরিকা, আরব বিশ্ব ও ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন করেছিলেন—আবদাল্লা হামদক—তাঁর মতো নেতৃত্বই এখন সুদানের স্থিতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এই পথনির্দেশনা সুদানসহ পুরো অঞ্চলকে নতুন ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে যেতে পারে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *